স্বদেশ কুমার মন্ডল, পত্নীতলা (নওগাঁ) প্রতিনিধি – পত্নীতলার পাটিআমলাই গ্রামের নাহিদা সুলতানা একজন গৃহবধু। লেখাপড়া জানা সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজের গ্রামকে নিয়ে বহুদিনের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রুপদিতে কাজ করছেন গ্রামের সকল মানুষের সাথে। সরেজমিনে পাটিআমলাই গ্রামে গিয়ে দেখা গেল কর্ম-ব্যস্ত নাহিদাকে। তিনি একদল স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গ্রামের রাস্তার দুপাশের লতাপাতা পরিষ্কার করছেন। তার সাথে সহযোগিতা করছেন জেসমিন আক্তার। তিনিও নাহিদার মতো গ্রামকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। তাই তার প্রতিবন্ধী ছেলেকে সাথে নিয়ে যোগ দিয়েছেন গ্রামের সামগ্রিক উন্নয়নের মিশনে। তাদের কাছ থেকে জানা গেল, তারা নিজেদের গ্রামকে পুষ্টি সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর গ্রাম হিসেবে ঘোষণা দিতে চলেছেন।
পাটিআমলাই সরদারপাড়ায় ১১৯টি পরিবারের বসবাস। বর্তমানে এখানে প্রতিটি পরিবার নিরাপদ পানির ব্যবহার, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস, গ্রামের প্রত্যেক নারী পুরুষ নিজেদের অধিকার কোথায় তা ভালোভাবে জানেন, গর্ভবতী নারীরা প্রসবকালীন এবং প্রসব পরবর্তী সেবার বিষয়ে ধারণা রাখেন এবং সেবা গ্রহণ করছেন।
গত ৩ বছরে এখানে ১৪জন শিশু জন্মগ্রহণ করেছে, যার ১১টি সরকারি হাসপাতালে নিরাপদ ডেলিভারির মাধ্যমে। পরবর্তীতে শিশুদের জন্ম নিবন্ধন, টিকা নিশ্চিতকরণ সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। এখানে বিদ্যালয়গামি প্রতিটি শিশু বিদ্যালয়ে গমন করে। গ্রামে তরুণরা নিজেদের সমৃদ্ধির জন্য ইয়ূথ ইউনিট গঠন এবং পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেছে। এখানে তারা নিয়মিত পাঠচক্র, সৃজনশীল প্রতিযোগিতা করে সমৃদ্ধ হচ্ছে। তরুণদের পাশাপাশি গড়ে ওঠা গণগবেষণা সমিতির মাধ্যমে নারীরা সঞ্চয় করছেন। বর্তমানে পাটিআমলাই গণগবেষণা সমিতির সঞ্চয়ের প্ররিমাণ প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। এ টাকা দিয়ে তারা নিজেদের প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করছেন। ফলে চড়া সুদে ঋণের বোঝা থেকে তারা ক্রমাগত মুক্তি পাচ্ছেন। প্রতিটি বাড়িতে হাঁস-মুরগি এবং দেশী গরুর খামার দেখা যায়। প্রত্যেক বাড়ির আঙ্গিনায় প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত শাক-সবজির মাচা রয়েছে।
গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা সিয়াম বলেছেন “স্বেচ্ছাব্রতি সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্ট তাদের গ্রাম উন্নয়নে নানাভাবে সহযোগিতা করছে। এখানে দেশীয় শাক-সবজি বীজ সংরক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছে বীজ ব্যাংক। আমরা এই বীজ ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রামের প্রত্যেক পরিবারকে ৭ প্রকার শাক-সবজি এবং একটি করে পেঁপের চারা দিয়েছি। এখন প্রত্যেক বাড়িতেই স্থায়ী পুষ্টির যোগান রয়েছে। আমাদের ক্ষুদ্র উদ্যোগ নিজেদের সামনে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।”
গ্রামবাসিদের এই উদ্যোগের সাথে যোগ দিয়েছে পাটিচরা ইউনিয়ন পরিষদও। গ্রাম উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসাবে কর্দমাক্ত রাস্তাটি হেয়ারিং করা হয়েছ । এছাড়াও গ্রামের জলাবদ্ধতা নিরোসন, মসজিদের উন্নয়ন, এবং মসজিদ হতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মিটার নতুন রাস্তা নির্মানে সহায়তা করেছে ইউনিয়ন পরিষদ।
পাটিআমলাই গ্রামের জেসমিন আক্তার দি হাঙ্গার প্রজেক্টের প্রশিক্ষিত নারী নেত্রী এবং পুষ্টি উজ্জীবক। তিনি টেকসই পুষ্টির লক্ষ্যে বৈশ্বিক জোট কর্মসূচিতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন। গর্ভবতীদের নিয়মিত ওজন, উচ্চতা এবং বাহুর পরিধি পরিমাপ করে পুষ্টির অবস্থা মূল্যায়ন করে অপুষ্টি মা দের মাতৃকণা দিচ্ছেন। এই গ্রামে এমন ১৩জন গর্ভবতী নিয়মিত এই সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করছেন। এছাড়াও ৫ বছরের কম বয়স স্বল্প ও মাঝারি অপুষ্টি ১২ জন শিশুকে পুষ্টিকণা বিনামূল্যে বিতরণ করছেন। তিনি গ্রামের সকল নারী ও পুরুষের ব্লাডপ্রেসার পরিমাপ করেন, নারীদের ব্লাড সুগার ও হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করে দেন। ফলে গ্রামের প্রত্যেক মানুষ তাকে গ্রামের ডাক্তারের মতো মনে করেন। তিনি সকল গর্ভবতী এবং প্রসুতিদের কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা প্রাপ্তিতে সহায়তা করছেন। এর ফলে গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছেন গ্রামবাসি।
উজ্জীবক আজিজুল ইসলাম বলেন বর্তমানে এই গ্রামে কোন বাল্যবিয়ে নাই। এখানকার প্রত্যেক শিশু নিজেদের উজ্বল ভবিষ্যৎ -নিয়ে পাঠে মনোযোগি। আমরা গ্রামকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে তুলেছি। আর এতে আমাদের নানাভাবে সহযোগিতা করে চলেছে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট । আমরা সবাই দিলে সম্প্রীতি এবং সুস্বাস্থ্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছি। আশা করছি, আমরা স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নে অগ্রসরদের তালিকায় থাকবো।”
দি হাঙ্গার প্রজেক্ট এর এলাকা সমন্বয়কারি আসির উদ্দীন বলেন পাটিআমলাই গ্রামের মতো পত্নীতলা উপজেলার ১১০টি গ্রামকে পুষ্টি সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর গ্রামে হিসেবে গড়ে তুলতে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। আগামি ২ মাসের মধ্যে আরও প্রায় ৫০টি গ্রামকে পুষ্টিসমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হবে বলে তিনি জানান। আর এভাবেই পর্যায়ক্রমে গ্রামের প্রতিটি পরিবার এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ সত্যিকার টেকসই উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে অবদান রাখবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন।