বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৬ অপরাহ্ন
নোটিশ
যে সব জেলা, উপজেলায় প্রতিনিধি নেই সেখানে প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। বায়োডাটা সহ নিউজ পাঠান। Email: newssonarbangla@gmail.com

ব্রিকস সম্প্রসারণে চীনের পরিকল্পনায় ভারত উদ্বিগ্ন কেন

Reporter Name
Update : বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০২৩, ৯:৪১ পূর্বাহ্ন

মারিয়া সিয়াও:

উদীয়মান অর্থনীতির ব্লক ব্রিকস সম্প্রসারণ পরিকল্পনা সমর্থন করে না সব সদস্য দেশ। বিশেষ করে এ পরিকল্পনা নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। বিশ্লেষকরা বলেন, বিদ্যমান আঞ্চলিক জোটগুলোকে মোকাবিলা করতে এই গ্রুপটি সমতুল্য হবে কিনা তা নিয়েই সংশয় আছে। আগামী মাসে জোহানেসবার্গে পরবর্তী সামিটে মিলিত হচ্ছে ব্রিকস সদস্য ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এ সময় এই ব্লকে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে ফ্রন্টরানারের মধ্যে আছে আর্জেন্টিনা, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, আলজেরিয়া, বাংলাদেশ এবং ইরান। এই ব্লককে সম্প্রসারণের বিষয়টি এজেন্ডায় থাকবে এমন প্রত্যাশা নিয়ে মঙ্গলবার সিনিয়র কর্মকর্তারা তিন দিনের মিটিং শুরু করেছেন।

ব্রিকসকে একসময় বিভিন্ন উদীয়মান অর্থনীতির একটি দুর্বল সংগঠন হিসেবে দেখা হতো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা। বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৩ ভাগ আছে এই ব্লকে। মোট ভূ-ভাগের শতকরা ২৬ ভাগে আছে তারা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির শতকরা প্রায় ৩০ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে এই ব্লক।

গত বছর চীন বলেছে, তারা চায় ব্রিকস নতুন সদস্য নেয়ার কাজ শুরু করবে। কিন্তু গত মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর বলেছেন, এই প্রক্রিয়া এখনো অগ্রসরমাণ।সম্প্রসারিত এই গ্রুপটি কেমন হবে সে বিষয়ে মান, ক্রাইটেরিয়া এবং প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন তিনি। ব্রাজিলের বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডাকাও গুটেলিও ভারগাসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সহযোগী প্রফেসর অলিভার স্টুয়েনকেল বলেন, ভারতের উদ্বেগ হলো- সম্প্রসারণের এই পরিকল্পনা নয়াদিল্লির কতোটা স্বার্থ রক্ষা করবে।

রাশিয়ার পরেই ব্রিকসকে সম্প্রসারণের এ পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী পরামর্শদাতা চীন- এ কথা উল্লেখ করে স্টুয়েনকেল বলেন, আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে, এমন বড় কোনো মুভমেন্ট হয় কিনা। ভারত এবং চীন উভয়েই একটি বড় গ্রুপে প্রভাব হারানো নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন বলে মনে করেন তিনি। ব্রিকস এরই মধ্যে পশ্চিমাবিরোধী একটি পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বৃটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে গড়ে ওঠা গ্রুপ-৭ বা জি৭-এর একটি বিকল্প মডেল ব্রিকস। এ কথা জানিয়ে স্টুয়েনকেল বলেন, নতুন যেসব সদস্য যোগ দেবে তারা ব্রাজিল বা ভারত নয়, খুব বেশি চীনের ঘনিষ্ঠ হবে। তিনি আরও বলেন, সম্প্রসারণ ঘটবে কিনা তা বিবেচনা না করেই বলা যায়, ব্রিকসের ৫টি দেশ এরই মধ্যে তাদের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করেছে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের ফেলো আনু আনোয়ার। তিনি বলেন, সম্প্রতি পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে পড়েছে ভারত। এ থেকে ধরে নেয়া যায় যে, তারা ব্রিকসের বাইরে (আউটলাইয়ার)। এর ফলে অন্য সদস্যরা এই ব্লকটিকে সম্প্রসারণ করতে যাওয়ার অর্থ আছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা শক্তিশালী করেছে দিল্লি। তারা নিরাপত্তা বিষয়ক গ্রুপ কোয়াডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে এক্ষেত্রে তারা করোনা মহামারিকালে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য টিকা উৎপাদন করেছে। কোয়াডে আছে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যাপী চীনের প্রভাবকে মোকাবিলার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর পুনরুজ্জীবন ঘটানো হয়েছে। আনু আনোয়ার বলেন, জি-৭ এর বিকল্প হিসেবে ব্রিকসের আবির্ভাব ঘটবে বলে মনে হয় না। কারণ, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডভুক্ত সব দেশই ন্যাটোর সদস্য অথবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য কোনো ফর্মে সামরিক জোটে আছে। এমন একটি জোট নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি, এ কথা উল্লেখ করে আনু আনোয়ার আরও বলেন, নিজেদের মধ্যে কোনো সামরিক জোট নেই ব্রিকসের  কোনো সদস্যের। নিকট ভবিষ্যতে তা গড়ে না ওঠার সম্ভাবনাই বেশি। সামান্য মধ্যম পর্যায়ের কিছু শক্তি এবং আঞ্চলিক শক্তির কাছে সদস্যপদ বিস্তৃত করার মধ্যদিয়ে বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় রকমের পরিবর্তন আসতে পারে। তবে বিকল্প আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তা অবদান রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের উপ-পরিচালক গুন্থার মাইহোল্ড। তিনি বলেছেন, নতুন একটি বিশ্ব ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হবে স্পষ্টতই চীন এবং রাশিয়ার স্বার্থে। এই উচ্চাকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য তারা মিলে ব্রিকসের সম্প্রসারণকে উৎসাহিত করছে। তিনি উল্লেখ করেন, এই সংগঠনের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে অধিক পরিমাণে আগ্রহী ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। মাইহোল্ড আরও বলেন, এই গ্রুপটিকে সম্প্রসারণ করা হলো চীনের স্বার্থ বা আগ্রহ এবং এর প্রভাব বিস্তার হতে পারে উল্টো ফল। কারণ, ব্রিকস অন্য সদস্য এবং অনানুষ্ঠানিক অন্য গ্রুপের বাধার মুখে পড়তে পারে। যা সম্প্রসারণের পর আয়ত্তে আনা অধিক কঠিন হবে। এর ফলে আরও বেশি পরিমাণে অভ্যন্তরীণভাবে বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি ভারত ও চীনের সীমান্তে সংঘাতের ফলে সৃষ্ট দুর্বল সম্পর্কের কথাই তুলে ধরেছেন এমন না। একই সঙ্গে তাতে আঞ্চলিক বৃহত্তর প্রতিযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবের মধ্যে পড়বে বলে মনে করেন তিনি। হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের অ্যাশ সেন্টারের সিনিয়র প্র্যাকটিশনার ফেলো শারলি জি ইউ। তিনি বলেন, সম্প্রসারিত ব্রিকসে এই ব্লক কতোটা শক্তিশালী তা প্রতিফলিত হতে পারে এবং বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রকাশ পেতে পারে। এর কারণ ব্রিকসের মোট জাতীয় প্রবৃদ্ধির দুই-তৃতীয়াংশের যোগানদাতা শুধু চীন। একটি সাধারণ বহুজাতিক ব্যবস্থায় যত বেশি সদস্য নেয়া হবে, চীন সেখানে নিয়মের নির্ধারক হয়ে উঠবে। তিনি উল্লেখ করেন, যেকোনো দেশ এই ভূমিকায় গেলে তারা কয়েক দশক ধরে বড় রকমের প্রভাব বিস্তার করবে।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের চায়না-আফ্রিকা ইনিশিয়েটিভের পরিচালক শারলি জি ইউ। তিনি বলেন, পশ্চিমা ব্লকের মতো নয় ব্রিকস। এর সদস্যরা একই অভিন্ন আদর্শ ধারণ করে না। এর পরিবর্তে উদীয়মান অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রতিফলিত করতে তারা বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সংস্কারে অভিন্ন ইচ্ছা রাখে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন
সদস্য দেশগুলো ব্রিকস প্রতিষ্ঠা করে ২০১৫ সালে। চীনা নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মতো করে উদীয়মান অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবকাঠামোতে অর্থায়ন করার লক্ষ্য ছিল নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি)। ব্রিকসের ওয়েবসাইট অনুযায়ী প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠাতা ৫ সদস্য দেশের ভেতরে কমপক্ষে ৯৬টি প্রকল্পে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে এনডিবি।

মে মাসে ব্যাংকটির বার্ষিক এক মিটিংয়ে চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ডিং সুয়েক্সিয়াং বলেছেন, এনডিবি’কে একটি উন্মুক্ত বহুজাতিক ব্যাংক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বেইজিং।

তিনি আরও বলেন, অধিক পরিমাণ অবকাঠামো এবং টেকসই প্রকল্পে অর্থায়নের মাধ্যমে উদীয়মান অর্থনীতিকে উন্নত সেবা দিতে গড়ে তোলা হয়েছে এনডিবি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরকে গ্রহণ করেছে এনডিবি। যোগ দেয়ার প্রক্রিয়ায় আছে উরুগুয়ে। যোগ দেয়ার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব।

স্টুয়েনকেল বলেন, আগেভাগে ব্যাংকটির সম্প্রসারণের কারণে নতুন দেশগুলো খুব শিগগিরই যোগ দিতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের মতো পশ্চিমা আধিপত্য বিস্তার করা বহুজাতিক ব্যাংকের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে এনডিবি। তিনি বলেন, এটা এরই মধ্যে হচ্ছেও।

স্টুয়েনকেল বলেন, অধিক শক্তিধর এবং অধিক প্রভাবশালী এনডিবি’র জন্য উন্নয়নশীল বিশ্বে খুব বেশি চাহিদা আছে। এনডিবি’র সম্প্রসারণ সম্ভবত তীব্র এবং তাতে ব্রিকসের প্রভাব হবে অনেক বেশি।

তবে আনু আনোয়ার বলেন, এনডিবি’র সম্পদ এবং তাদের কাজের এরিয়া এটাই বলে দেয় যে, তারা শুধু সম্পূরক ভূমিকা রাখবে। তারা বর্তমানে বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের স্থান দখল করতে সক্ষম নয়। নতুন সদস্য যুক্ত করার ফলে অবশ্যই তহবিল বড় হবে এবং ওইসব অবকাঠামোখাতে কাজের এলাকা সম্প্রসারিত হবে। কিন্তু তা বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক ও তাদের টিকে থাকার বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের ভূমিকা মুছে দিতে পারবে না।

(লেখক চীনভিত্তিক দীর্ঘ সময়ের সাংবাদিক ও পূর্ব এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তার আছে মাস্টার্স ডিগ্রি। তার এ লেখাটি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে অনূদিত)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Theme Created By Uttoron Host