ইউক্রেনকে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বাণিজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে রুশ নৌ বাহিনী ইউক্রেনের কৃষ্ণ সাগর উপকূলের কিছু দূরে অবরোধ স্থাপন করেছে, একথা জানিয়েছে বৃটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। কৃষ্ণ সাগর রাশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য মাধ্যম। বৃটিশ মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে , রুশ নৌ বাহিনী ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা জারি রেখেছে । একটি গোয়েন্দা সূত্র জানাচ্ছে , রাশিয়া আগামী সপ্তাহে আরো ল্যান্ডিং অপারেশন পরিচালনা করতে পারে, যা আজভ সাগরে ইতিমধ্যেই পরিলক্ষিত হয়েছে। এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেট এন্টনি ব্লিঙ্কেন রবিবার উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থার সদস্য পোল্যান্ডের সীমান্তের কাছে একটি বৃহৎ ইউক্রেনীয় ঘাঁটিতে রাশিয়ার হামলার নিন্দা করেছেন, যেখানে একজন স্থানীয় কর্মকর্তার মতে ৩৫ জন নিহত এবং ১৩৪ জন আহত হয়েছে। মিঃ ব্লিঙ্কেন টুইটারে লিখেছেন- ”আমরা ইউক্রেনের সীমান্তের কাছে ইয়াভোরিভে শান্তিরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য স্থাপিত আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নিন্দা জানাই,বর্বরতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ” রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রক বলেছে যে এই বিমান হামলা বিদেশী দেশগুলির দ্বারা সরবরাহ করা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ধ্বংস করেছে যা বিস্তীর্ণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। হামলার জেরে ১৮০ জন বিদেশী ভাড়াটে নিহত হয়েছে।  পোলিশ সীমান্ত থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী। রাশিয়া শনিবারই সতর্ক করেছিল যে ইউক্রেনে পশ্চিমা অস্ত্রের চালানের কনভয়কে তারা লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে। বৃটেন জানাচ্ছে , ঠিক সেটাই তারা করেছে। হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান, একটি বক্তৃতায় বলেছেন, ন্যাটো অঞ্চলে যে কোনও আক্রমনের পূর্ণ জবাব দেয়া হবে।আঞ্চলিক গভর্নর ম্যাকসিম কোজিটস্কি বলেছেন যে রাশিয়ান বিমানগুলি ইয়াভোরিভ স্থাপনায় প্রায় ৩০ টি রকেট ছুড়েছে যার জেরে অন্তত ৩৫ জন নিহত ও ১৩৪ জন আহত হয়েছেন। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগর কোনাশেনকভ খবরটি নিশ্চিত করে বলেছেন, ”রাশিয়া ইয়াভোরিভ এবং স্টারিচি গ্রামে একটি পৃথক স্থাপনায় হামলার জন্য নির্ভুলভাবে দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ফলস্বরূপ ১৮০ জন বিদেশী ভাড়াটেকে হত্যা এবং বিপুল পরিমাণ বিদেশী অস্ত্র ধ্বংস করা গেছে।” ইউক্রেন, যার ন্যাটোতে যোগদানের আকাঙ্ক্ষা রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে একটি প্রধান বিরক্তির কারণ , আক্রমণের আগে পশ্চিমা দেশগুলির সাথে বেশিরভাগ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছিল। শেষ বড় মহড়া হয়েছিল সেপ্টেম্বরে। ২৪ ফেব্রুয়ারী রাশিয়ার আক্রমণের কয়েক সপ্তাহ আগে, ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী সীমান্তের কাছে ইয়াভোরিভে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। ইউক্রেনীয় মিডিয়া অনুসারে, সমস্ত বিদেশী প্রশিক্ষক ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে সেখানে সরঞ্জাম রেখে চলে যায়।ইউক্রেনীয় মেডিকেল রিজার্ভের একজন কর্মকর্তা কর্নেল লিওনিড বেনজালো জানাচ্ছেন, রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জেরে ডাইনিং রুম , ডরমেটরি ,ব্যারাকগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। যদিও পশ্চিমা দেশগুলি কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মিঃ পুতিনকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছে এবং ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করছে, তবুও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ন্যাটোকে সংঘাতে টানা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

কারণ ইউক্রেনে কোন ন্যাটো সদস্য নেই। এরই মধ্যে রাজধানী কিয়েভ জুড়ে বিমান হামলার সাইরেন বেজে উঠেছে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলেছে যে তারা দুই সপ্তাহের জন্য খাদ্য আইটেম মজুদ করে রেখেছে। কারণ রাশিয়ান বাহিনী শহরটি ঘিরে ফেলার পর সেখানে দুই মিলিয়ন মানুষ এখনো রয়ে গেছেন। ইউক্রেন পশ্চিমে একটি বিমানবন্দরে নতুন করে বিমান হামলা এবং রাজধানীর উত্তর-পূর্বে চেরনিহিভে ভারী গোলাবর্ষণের খবর দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ভাদিম ডেনিয়েঙ্কো বলেছেন, ইউক্রেনের বাহিনী পূর্ব খার্কিব অঞ্চলে এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মাইকোলাইভের আশেপাশে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। আঞ্চলিক পুলিশ প্রধান বলেছেন, কিয়েভের উত্তর-পশ্চিমের ইরপিন শহরে একজন আমেরিকান সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করেছে রুশ সেনা এবং অন্য একজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন।সহিংসতা সত্ত্বেও, উভয় পক্ষই পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত আলোচনায় অগ্রগতির সম্ভাবনা সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন দিয়েছে। ইউক্রেনের আলোচক মাইখাইলো পোডোলিয়াক অনলাইনে একটি ভিডিওতে বলেছেন, ‘রাশিয়া ইতিমধ্যে গঠনমূলক কথা বলতে শুরু করেছে’, আমি মনে করি যে কিছু দিনের মধ্যে আক্ষরিক অর্থে আমরা কিছু ফলাফল অর্জন করব। ‘ একজন রাশিয়ান প্রতিনিধি, মিঃ লিওনিড স্লুটস্কি, আরআইএ সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন যে তারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আশা করছেন এবং প্রতিনিধি দলগুলি শীঘ্রই খসড়া চুক্তিতে পৌঁছাতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তবে কোনোপক্ষই বলে নি যে এটি কিভাবে সম্ভব। বেলারুশে দুই পক্ষের মধ্যে তিন দফা আলোচনা গত সোমবার। যেখানে প্রধানত ফোকাস করা হয়েছে মানবিক ইস্যুকে । কিন্তু সেই আলোচনা থেকে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য উঠে এসেছে। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা ওলেক্সি আরেস্তোভিচ জাতীয় টেলিভিশনকে বলেছেন, “এখনও আলোচনা চলছে”। যদিও ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ একথা অস্বীকার করেছেন। একটি টুইটার পোস্টের মাধ্যমে মার্কিন সফ্টওয়্যার সংস্থা মাইক্রোসফ্ট , ওরাকল এবং জার্মান ব্যবসায়িক সফ্টওয়্যার গ্রুপ এসএপিকে রাশিয়ায় সহায়তা পরিষেবা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি। রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে ২.৫ মিলিয়নেরও বেশি লোক ইউক্রেনের সীমানা পেরিয়ে পালিয়েছেন এবং কয়েক লক্ষ লোক অবরুদ্ধ শহরগুলিতে আটকা পড়েছেন । ইউক্রেনের মানবাধিকার পর্যবেক্ষক বলেছেন যে রাশিয়া পূর্ব লুহানস্ক অঞ্চলের পোপাসনা শহরে রাতের হামলায় ফসফরাস বোমা ব্যবহার করেছে এবং যা যুদ্ধাপরাধের সমান ।ফসফরাস অস্ত্র যুদ্ধে আলো সরবরাহ করতে, স্মোকস্ক্রিন তৈরি করতে বা ভবন পোড়াতে ব্যবহার করা হয়। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাশিয়ান সৈন্যরা দক্ষিণে মারিপোল এবং উত্তরে খারকিভ বন্দরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মারিউপোলের সিটি কাউন্সিল এক বিবৃতিতে বলেছে যে আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে ২,১৮৭ জন বাসিন্দাকে হত্যা করা হয়েছে।ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ সবচেয়ে ভারী বোমা হামলার শিকার হয়েছে। কিয়েভের উত্তর-পূর্বে চেরনিহিভে, দমকলকর্মীরা ভারী গোলাগুলির পরে একটি জ্বলন্ত বিল্ডিং থেকে বাসিন্দাদের উদ্ধার করেছেন। এদিকে মস্কো বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর কথা অস্বীকার করেছে। উল্টে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টার জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করেছে তারা। ইউক্রেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেশচুক জাতীয় টেলিভিশনে বলেছেন যে ১ লক্ষ ৪০ হাজারেরও বেশি লোককে সংঘাতপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু মানবিক কনভয় গোলাগুলির কারণে মারিউপোলে পৌঁছাতে পারেনি। এদিকে ক্রেমলিনের আগ্রাসন শব্দটি পছন্দ নয়, তারা বারবার বলে আসছে ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ এবং “ডি-নাজিফাই” করার জন্য তারা এই বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে ইউক্রেনের বুকে।

সূত্র : www.straitstimes.com