রেজাউল হক, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: বিলের কম পানিতে দাঁড়িয়ে কেউ মাছ ধরছেন, আবার কেউ গবাদি পশুর খাবার, হাঁসের জন্য শামুক অথবা নিজেদের খাবারের জন্য শাপলা সংগ্রহ করছেন। এরকম ছোট-কাজের গুত্বপূর্ণ বাহন হলো কোষা নৌকা। যাকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘ডুঙ্গা’ নামে ডাকা হয়।
নড়াইলের বিলগুলোয় কম পানিতে তাল গাছের তৈরি এসব ডুঙ্গা পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করেন।
হাতিয়াড়া গ্রামের মালতি রানী সকালে বিলে গিয়েছেন মাছ ধরতে। নির্জন এলাকায় দাঁড়িয়ে বড়শি দিয়ে ধরেছেন দেশি কয়েকটি পুঁটি আর টাকি মাছ। ফেরার পথে তুলে আনছেন কলমি শাক, শাপলা আর গরুর জন্য ঘাস। ডুঙ্গা ভর্তি করে বিকেলে বাড়ি ফিরেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। এভাবে একে একে ফিরলেন সিগ্ধা রানী, আরতি বিশ্বাসসহ নবীন আর প্রবীণ গৃহিণীরা। সন্ধ্যা নেমে আসছে তখনও বিলের এক কোনায় মাছ ধরছেন কমলা রানী। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নড়াইলের বিল এলাকার চিত্র এ রকমই।
বিল আর খালে পরিপূর্ণ জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখন তাল গাছের তৈরি ডুঙ্গার ব্যবহার চলছে। বিল পাড়ের হাজারো মানুষের বাহন এই ডুঙ্গা। খালে প্রবেশ করতে, খাল পাড়ি দিয়ে বাজার, বিল থেকে মাছ ধরা-শাপলা তোলার কাজে ব্যবহার হয় গ্রামীণ জনপদের এই বাহন। এ বছর পানি কম হওয়ায় নৌকার থেকে খালে-বিলে ডুঙ্গার চলাচল বেশি হলেও হাটগুলোয় দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে।
নড়াইল-যশোর সড়কে তুলারামপুরের হাটটি ডুঙ্গার জন্য বড় একটি হাট। এখানে সপ্তাহের শুক্রবার ও সোমবার হাট বসে। একটি ছোট ডুঙ্গা দুই হাজার আর মাঝারি থেকে বড়টি ৫/৭ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলারামপুর হাটে ডুঙ্গা কিনতে আসেন কৃষকসহ গৃহস্থ বাড়ির কর্তারা। যশোরের অভয়নগর থেকে ডুঙ্গা কিনতে এসেছেন রকিব মোল্যা। তিনি বড় সাইজের একটি ডুঙ্গা কিনেছেন সাড়ে তিন হাজার টাকায়। জানালেন, ঘেরে মাছের খাবার দিতে এই ডুঙ্গা কাজে লাগে। গতবছরের তুলনায় কম দামে ডুঙ্গা কিনেছেন তিনি।
ডুঙ্গা বিক্রেতা চর শালিখা গ্রামের সেলিম মোল্যা বলেন, এ বছর বিলে পানি কম হওয়ায় ডুঙ্গার চাহিদা কম। গতবছর যে ডুঙ্গা বিক্রি করেছি চার হাজার, সেটি এবার দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তালগাছ আর শ্রমিকের দামও উঠছে না।
একটি তালগাছ থেকে দুটি ডুঙ্গা তৈরি হয়। তালগাছের গোঁড়া মাটির ভেতর থেকে বের করে শিকড়সহ গাছটি কাটা হয়। এরপর গোঁড়ার অংশটি সুচালো করে নয় হাত রেখে আলাদা করা হয়। গাছটির মাঝামাঝি অংশ দাগ দিয়ে হাত করাত দিয়ে ধীরে ধীরে এপাশ ওপাশ কেটে দুভাগ করে ফেলা হয়। ভেতরের নরম অংশ কোদাল আর শাবল দিয়ে কুপিয়ে পরিষ্কার করে তৈরি হয় ডুঙ্গা। এরপর হাত বাশলে দিয়ে ধীরে ধীরে কেটে-ছেঁচে সুন্দর আকারের ডুঙ্গা তৈরি করে তা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয়।
লোক সংস্কৃতি গবেষক অধ্যক্ষ রওশন আলী বলেন, দেশিয় প্রযুক্তির এই বাহন লোক সংস্কৃতির অংশ। এলাকায় অধিক সংখ্যায় মাছের ঘের হওয়ায় বিলে পানি কমে গিয়ে ধীরে ধীরে ডুঙ্গার ব্যবহার কমছে। খালে ও বিলে পানি প্রবাহ সঠিক রাখতে না পারলে জীব-বৈচিত্র্য ব্যহত হবে।