রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:২২ পূর্বাহ্ন
নোটিশ
যে সব জেলা, উপজেলায় প্রতিনিধি নেই সেখানে প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। বায়োডাটা সহ নিউজ পাঠান। Email: newssonarbangla@gmail.com

ব্রিকস থেকে ‘ব্রিকসবি’

Reporter Name
Update : সোমবার, ২৬ জুন, ২০২৩, ৭:৪০ অপরাহ্ন

ব্রিকসে যোগ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, আর তাতে করে হয়তো এতদিনের ব্রিকস পরিণত হতে পারে ‘ব্রিকসবি’তে। যদিও যোগদানের কাতারে আছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোও। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আগস্টে ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনে জানা যাবে বিশ্ব রাজনীতির খেলায় আসলে কী হতে যাচ্ছে।

কূটনীতিবিদদের মতে, ব্রিকসের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী ধরা হয় জি-৭ কে। একদিকে জি-৭ এ আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স এবং জাপান; অন্যদিকে ব্রিকসের সদস্য ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। জন্মলগ্ন থেকে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উঠতি অর্থনীতির দেশগুলোর সংগঠন নিয়ে পশ্চিমাদের হাসি-তামাশার শেষ ছিল না।

২০১১ সালে ফিনান্সিয়্যাল টাইমসের কলামিস্ট ফিলিপ স্টিভেন বলেছিলেন, ‘শুরুর আগেই ব্রিকস শেষ। ঢাল-তলোয়ার ছাড়া যে অর্থনৈতিক জোটটি গড়ে উঠেছে তার টিকে থাকার দিন ফুরিয়ে এসেছে।’ এক বছর পর আরেক পশ্চিমা কলামিস্ট মার্টিন উলফ বলেছিলেন, ‘ব্রিকসকে কোনোভাবেই একটি সংগঠন বলা যায় না। কয়েকটি দেশ, যাদের আদর্শগত কোনো মিল নেই, তারা এক হয়ে সংগঠন করছে; ব্যাপারটা হাস্যকর।’ 
 
মার্টিন অবশ্য ঠিকই বলেছিলেন। ব্রিকসের সদস্যদের মধ্যে দৃশ্যমান কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। একদিকে গণতান্ত্রিক ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা, অন্যদিকে এক রকমের স্বৈরতান্ত্রিক রাশিয়া ও চীন। এছাড়া ভারত-চীনের দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক অসমতা, আমদানি-রফতানির আলাদা বাজার; সব মিলিয়ে একটি হযবরল অবস্থা। তবে এত কিছুর পরও ব্রিকসের মূল শক্তি দেশগুলোর একজোট থাকার মনোভাব। পশ্চিমাদের আধিপত্য কমিয়ে নিজেদের সক্ষমতাকে জাহির করা।
 
এ ব্যাপারে সাও পাওলোর গেটুলিও ভারগাস ফাউন্ডেশনের সহযোগী অধ্যাপক অলিভার স্টুকেঙ্কেল বলেন, এতসব দ্বান্দিক অবস্থা থাকার পরেও কখনো এমন হয়নি ব্রিকসের সম্মেলনে পাঁচ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কেউ কখনো অনুপস্থিত ছিলেন। এমনকি করোনার সময়েও ভার্চুয়ালি ব্রিকস তার সম্মেলন চালিয়ে গেছে। এ থেকে একটি ব্যাপারে অন্তত শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়- ব্রিকসের সদস্যরা নিজেদের ঐক্যের প্রশ্নে আপোষহীন।

এই ঐক্যের সুফল ইতোমধ্যে পেয়েছে ব্রিকস। যে জি-৭ ও পশ্চিমারা ব্রিকস নিয়ে এতদিন হাসি-তামাশা করে এসেছে সেই জি-৭ এর জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে ব্রিকস। অ্যাক্রন ম্যাক্রো কনসাল্টিং-এর দেয়া তথ্যানুযায়ী, সম্মিলিতভাবে ব্রিকস দেশগুলোর বর্তমান জিডিপির পরিমাণ ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। এর বিপরীতে জি-৭ এর সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ।

 
অধ্যাপক অলিভারের মতে, বিশ্ব শাসন ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন আসছে। কয়েক দশকের মধ্যে পশ্চিমাদের হাতে আর বিশ্ব পরিচালনার ক্ষমতা থাকবে না। ক্ষমতার মুকুট চলে আসবে মূলত এশিয়ার হাতে; আর সে হিসেবে এখন থেকেই নিজেদের প্রস্তুত করতে শুরু করেছে ব্রিকস।
 
২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া আক্রমণ, ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান কিংবা ব্রাজিলের বলসেনারোকে সমর্থনে ব্রিকস সবসময় একজোট ছিল। পশ্চিমারা যখন রাশিয়াকে একঘরে করে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তখন ভারত, চীন, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা দাঁড়িয়েছে রাশিয়ার পাশে। ফলশ্রুতিতে রাশিয়াকে একঘরে করে উল্টো বিপদের মুখে পড়েছে পশ্চিমারা। একদিকে মন্দাভাব, অন্যদিকে জ্বালানি সংকটে ইউরোপের অর্থনীতি দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি জি-৭ ও ব্রিকসের জিডিপির পার্থক্যই প্রমাণ করছে বিশ্ব রাজনীতির খেলায় বল এখন ব্রিকসের পায়ে।
 

বাংলাদেশের কী লাভ?

বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ততটা উষ্ণ যাচ্ছে না। অযথা নজরদারি ও চাপ প্রয়োগকে ভালোভাবে দেখছে না ঢাকা। আকারে ক্ষুদ্র হলেও ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয়। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় একেবারে নিরপেক্ষ থাকা যখন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও বাংলাদেশ রাজনৈতিক দিকটিকে সামনে না এনে অর্থনৈতিক দিকেই জোর দিচ্ছে। তবে ধারণা করা যাচ্ছে, ব্রিকসে যোগদানের মাধ্যমে বিশ্ব মেরুকরণের খেলায় সরাসরি পা রাখছে বাংলাদেশ।

 
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব সাব্বির আহমেদ চৌধুরি সময় সংবাদকে বলেন, ‘পররাষ্ট্রনীতি অনুসারে বাংলাদেশ যখন কোনো সংগঠনে যোগ দিতে যায় তখন সর্বাগ্রে থাকে অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টি। ব্রিকসের ক্ষেত্রেও তাই। বিশ্বে যেভাবে ডলার সংকট দেখা যাচ্ছে, সেখানে ব্রিকসের নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন একটি মুদ্রাব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি মোটেও সহজ হবে না; তবে দেশগুলোর মধ্যে সাংগঠনিক সম্পর্ক থাকলে অসম্ভব কিছু না।’
 
সম্প্রতি সুইজারল্যান্ড সফর শেষে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এককভাবে কারও ওপরে নির্ভরশীল থাকতে চায় না। একক নির্ভরশীলতা কমাতেই বাংলাদেশ ব্রিকসে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এছাড়া অর্থ বিনিময়ে সুবিধা পাওয়া, প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সুবিধার কথা মাথায় রেখে ব্রিকসে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
 
খেয়াল করলে দেখা যাবে, ব্রিকসের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের রফতানির থেকে আমদানির সম্পর্ক অনেক বেশি। এক্ষেত্রে ব্রিকসে যোগ দিলে বাংলাদেশের আমদানি ব্যবস্থার ওপরে চাপ কমবে এবং বিকল্প মুদ্রাব্যবস্থা চালু হলে ডলারের ওপরেও চাপ কমবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

 

তবে ব্রিকসে যোগ দিলে পশ্চিমাদের সঙ্গে রফতানি বাণিজ্যে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফি বলেন, ‘এমন  না যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের থেকে পণ্য নিয়ে অনুগ্রহ দেখাচ্ছে। তারা সস্তায় বাংলাদেশের থেকে পণ্য পায় বলেই কেনে। ব্রিকসে যোগ দিলে এর ওপরে কোনো প্রভাব পড়বে না। যেখানে ভারত ও চীনের মতো দেশ ব্রিকস গঠনের পর পশ্চিমাদের সঙ্গে বাণিজ্যের সম্পর্কের কোনো অবনতি হয়নি, সেখানে বাংলাদেশও ব্রিকসে যোগ দিলে কোনো সমস্যা হবে না। উল্টো চলতি বছরেই বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগ দেয়া একটি সময়পোযোগী সিদ্ধান্ত।’ 
 

নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক ও সম্ভাবনা

পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক আধিপত্যের মূল জোর ডলার। এছাড়াও আছে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে টেক্কা দিতেই ব্রিকস গড়ে তুলেছে নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)।

 
বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য না হলেও শুরু থেকেই নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) সদস্য ছিল। সম্প্রতি নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ জানিয়েছেন, এনডিবি’র ৩০ শতাংশ ঋণ ডলারে না দিয়ে স্থানীয় মুদ্রায় দেবে। ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা এ পরিকল্পনা এনডিবি থেকে দেয়া ঋণের ৩০ শতাংশ সদস্য দেশগুলোর স্থানীয় মুদ্রায় দেয়া হবে।
 
সে হিসেবে বাংলাদেশ ব্রিকসে যোগ দিলে এনডিবি থেকে নিজ মুদ্রায় ঋণ পাবে ও দিন দিন বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের মতো সংগঠনগুলোর ওপরে একপাক্ষিক মুখাপেক্ষিতা কমে আসবে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ব্রিকসে যোগ দিলে বাংলাদেশের অর্থায়নের নতুন আরেকটি ক্ষেত্র তৈরি হবে।

এর বাইরে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাচ্ছে। এ মর্যাদা পাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ হারাবে কিছু সহজ বাণিজ্য সুবিধা। সেক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে এর আগেই দ্বিপাক্ষিক ও সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে ব্রিকসে যোগ দেয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অনেকেই।

 
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র সচিব সাব্বির আহমেদ চৌধুরি বলেন, ২০২৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বেশ কিছু শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা হারাবে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর সহজে কেউ বাংলাদেশকে এই সুবিধা দিতে চাইবে না। এক্ষেত্রে ব্রিকসে যোগ দিলে কিংবা আলাদা মুদ্রাব্যস্থার সঙ্গে পরিচিত হতে পারলে বাংলাদেশ একটি ভালো অবস্থান নিতে পারবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Theme Created By Uttoron Host