রেজাউল হক নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: সতেরো বছর সংসার করার পর নবাব ফয়জুন্নেসা বুঝতে পারেন তার স্বামী জমিদার জনাব সৈয়দ মোহাম্মদ গাজীর আগের একটা বৌ আছে। সেদিনই তিনি বাবার বাড়ি ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু জমিদার জনাব সৈয়দ মোহাম্মদ গাজী সেটা মানতে নারাজ।এদিকে ফয়জুন্নেসার বাবা জমিদার আহমদ আলী চৌধুরী মুঘল সম্রাজ্যের একজন উত্তরাধীকারি ছিলেন। কাজেই তাকে আটকে রাখার মত হিম্মত দেখানোর জন্য সাহসের প্রয়োজন। কিন্তু সৈয়দ মোহাম্মদ গাজীর সে সাহস নেই, কারণ তিনি সত্যিই প্রতারনা করেছেন।ফয়জুন্নেসা এক সপ্তাহ ধরে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। মোহাম্মদ গাজী শর্ত জুড়ে দিলেন।
তার আগের স্ত্রী নিঃসন্তান ছিলো। ফয়জুন্নেসা যদি তার কন্যা আরশাদুন্নেসাকে রেখে যায় তাহলে সে নিজের বাপের বাড়ি যেতে পারে।ফয়জুন্নেসা বাবার বাড়ি ফিরে গেলেও পরে কাবিনের টাকা থেকে তৎকালীন এক লক্ষ টাকা মূল্যে পশ্চিমগাঁও (বর্তমানে লাকসাম) একটি বাড়ি করেন। আমাদের আজকের গল্প হলো সেই বাড়িকে নিয়েই।বেগম রোকেয়াকে নারী শিক্ষার অগ্রদূত বলা হলেও বেগম ফয়জুন্নেসা তার জন্মেরও বহু আগে জ্ঞানার্জনে ব্রতী হন। তার আগ্রহ দেখে তার বাবা তাজউদ্দিন নামে এক গৃহ শিক্ষক রেখে দিলেন। সেই গৃহ শিক্ষকের আন্তরিকতায় বেগম ফয়জুন্নেসা বাংলা, আরবী, ফার্সি ও সংস্কৃত এই চার ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। একে একে রচনা করেন ‘নুরজালাল’ ‘সঙ্গীত লহরী’ ও ‘সঙ্গীত সার’। বেগম রোকেয়ার জন্মের সাত বছর পূর্বে ১৮৭৩ সালে তিনি কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। নারী শিক্ষায় তিনি অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন। মহিলা নবাব বললে হয়তো অনেকে হাসবে। মহিলা আবার নবাব হয় নাকি? আবার অনেকে মনে করে নারীদের অধিকার দেওয়া হয়েছে আধুনিক যুগে। নারীর ক্ষমতায়ন করা হয়েছে খালেদা-হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে। মোটেই না।নবাব ফয়জুন্নেসা ১৮৭৩ সালে বাবার জমিদারি লাভ করেন। ১৮৮৫ সালে মায়ের সম্পত্তির অধিকারিনীও হন।এবং খুবই দক্ষতার সাথে জমিদারি পরিচালনা করেন। তিনি ছিলেন প্রজা বান্ধব নবাব। ইতিহাসে প্রথম নারী নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। ফয়জুন্নেসা তার চিন্তা কাজ কর্মে ছিলেন সে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। সেকালের সমাজ ব্যবস্থার সবরকম বাধা পেরিয়ে তিনি সম্পূর্ণ কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনে মনযোগ দিয়েছিলেন। তাই একজন নারী হয়েও সে সময়ে জমিদারির কঠোর দায়িত্ব তিনি সফলভাবে পালন করতে পেরেছেন। তিনি নির্ভীকভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করেন।তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে ওয়ারিশদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেন আর নিজ জমিদারিটি পরিনত করেন ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি হিসেবে। এমন নবাব আর পাওয়া যায় নি। শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেয়েদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও সুচিকিৎসারও ব্যবস্থা করেন। ১৮৯৩ সালে কুমিল্লা শহরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফয়জুন্নেসা হাসপাতাল’। ঐতিহ্যবাহী ‘নবাব ফয়জুন্নেসা কলেজ’ কলেজ’ তারই স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।১৮৯৩ সালে নওয়াব বাড়ির কাছেই তিনি মেয়েদের জন্য একটি স্বতন্ত্র হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনেকগুলো দাতব্য প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এতিমখানা এবং সড়ক নির্মান করে তার মানবতাবাদী ও সমাজ সংস্কারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি নওয়াব বাড়ীর সদর দরজায় একটি দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৪ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করার সময় তিনি মক্কায় হাজীদের জন্য একটি ‘মুসাফিরখানাও প্রতিষ্ঠা করেন।আমাদের এদেশে তখন বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বিদ্যমান ছিল। নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি জনহিতকর কাজেও প্রচুর অর্থ দান করতেন।
বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির নিভৃত পল্লীর এ বিদূষী রমণী বেঁচে থাকতে তার কাজের স্বীকৃতি সেভাবে পাননি।মহারাণী ভিক্টোরিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ফয়জুন্নেসাকে ‘বেগম’ এবং এরপর ‘নওয়াব’ উপাধি দেন। ১৮৮৯ সালে তার নির্দেশক্রমে ফয়জুন্নেসাকে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘নওয়াব’ উপাধি দেয়া হয়।২০০৪ সালে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এ মহীয়সীর জীবনাবসান ঘটে। তাকে তার প্রতিষ্ঠিত দশগুম্বুজ মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।