সনত চক্রবর্ত্তী, ফরিদপুর :
বাবুই পাখিরে ডাকি, বলেছি চড়াই-
‘কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই;
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকার ‘পরে,
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।’
কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী শৈল্পিক পাখি আজ শহুরে ব্যস্ততা আর কোলাহলে বিলুপ্তের পথে। গ্রামীণ পরিবেশ থেকেও তালগাছ বিলুপ্তির পথে হওয়ায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বাবুইপাখি ও তার বাসা। বাবুইপাখির তৈরি বাসা কোন সাধারণ বাসা নয়, এটা এক অনন্য শৈল্পিক কারুকাজ। যা মানুষের মনের চিন্তার খোরাক। এই শিল্পের মাধ্যমে মানুষকে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
কিন্তু কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী ছড়াটির নায়ক শৈল্পিক বাবুই পাখি আজ বিলুপ্তির পথে।
গ্রামাঞ্চলে আগের মতো আর এই শৈল্পিক, কারিগরী পাখিটিকে চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
এক সময় ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই পাখি দেখা যেত বিভিন্ন উচুঁ তাল গাছ, খেজুর গাছে। বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা এই শৈল্পিক পাখি নিয়ে তৈরি করেছেন কবিতা, গান।
কিন্তু আজ সেই বাবুইপাখির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন।
আজ থেকে ২৫-৩০বছর আগে বোয়ালমারী উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে এই শৈল্পিক পাখি দেখা মিলত। বর্তমানে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস,অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জমিতে সার ব্যবহার, তালগাছ, খেজুর গাছ কাটার কারণে আজ আর এই শৈল্পিক পাখি চোখে পড়ে না।
বাবুই পাখির বাসা তৈরির জন্য প্রথম পছন্দ উচুঁ তালগাছ বা খেজুর গাছ। বাবুই পাখি বাসা তৈরিতে খুবই পরিশ্রম করে। প্রথমে ঠোঁট দিয়ে ঘাসের আস্তরণ সরায়। যত্ন করে পেট দিয়ে ঘষে পালিশ করে। এই ভাবে উঁচু তাল বা খেজুর গাছে খড়কুটো দিয়ে তৈরি করে শৈল্পিক বাসা। যা পরবর্তিতে হয়ে উঠে আকর্ষনীয় দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক বাসা। এই শিল্পীর বাসা তৈরিতে ধানের পাতা, তালের কচিপাতা,খড়ের ফালি, ছন ব্যবহার করে বাসা তৈরি হওয়ার পর মজবুত হয়ে ওঠে যা ঝড়ে ছিড়ে যায় না।
এক সময় বিভিন্ন পাখির কিচিরমিচির শব্দে মানুষের ঘুম ভাঙ্গতো, বিশেষ করে বাবুই পাখি কারণ বাবুই বিভিন্ন মানুষের ঘরে বাস করত। এখন আর কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয় না এই অঞ্চল। এক সময় এই অঞ্চলে দুই ধরনের বাবুই পাখি দেখা যেত, দেশি বাবুই পাখি ও বাংলা বাবুই পাখি। তবে দেশি বাবুই পাখি আজ বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে কিছু এলাকায় দেশি বাবুই পাখি দেখে যায়।
এই শৈল্পিক পাখি বাসা তৈরির শুরুতে নিম্ন মুখি গর্ত বন্ধ করে, তাতে ডিম রাখার স্থান তৈরি করে। তারপর প্রবেশ ও বের হবার জন্য পথ তৈরি করে। বাসা তৈরি করে বাবুই অন্য বাবুয়ের বা সঙ্গীর খোঁজে তার বাসাতে প্রবেশ করে। সঙ্গী পছন্দ হলে পুরুষ বাবুই স্ত্রী বাবুই পাখিকে তার বানানো ঘর দেখাতে নিয়ে আসে। স্ত্রী বাবুই পাখি যদি পুরুষ বাবুই পাখির ঘর পছন্দ হয় তাহলে পুরুষ বাবুই পাখি তার ঘর ৪/৫ দিনের মধ্যে তৈরি করে।
এই শৈল্পিক পাখির প্রজনন মৌসুম হচ্ছে ধান পাকার সময়, প্রজনন শেষ হলে ডিম হয়,
ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পরপরই বাচ্চাদের খাবার সংগ্রহের জন্য স্ত্রী বাবুই ধান থেকে দুধ ধান সংগ্রহ করে।
এই ভাবে চলতে থাকে শৈল্পিক বাবুইপাখির জীবন ।
জেলা পরিষদ এর সদস্য আবু জাফর সিদ্দিকী বলেন আমি ছোট কাল থেকে এই শৈল্পিক পাখি দেখে এসেছি, আজ আর তেমন দেখা যায় না। জমিতে কীটনাশক ব্যবহার,তালগাছ কাটার কারণে, বন্যা,ঝড়,পাখি নিধন এর করনে আজ শৈল্পিক পাখি বিলুপ্ত। যদি পাখি প্রেমিরা তাদের রক্ষাতে এগিয়ে আসতো তাহলে শৈল্পিক পাখি বা অন্য পাখি বৃদ্ধি পেতো।