বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫, ১১:৫২ অপরাহ্ন
শিরোনাম
আদিতমারী উপজেলার নামুড়ী উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের ছয় মাসের সাজা ‘টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন-২০২৫’’ শীর্ষক ২ দিন ব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠান একটি দৃঢ় সংকল্প: ভালোবাসা এবং কঠোর পরিশ্রমের এক জীবন্ত গল্প কয়রায় প্রধান শিক্ষক আ. খালেকের অবসরজনিত বিদায়ী সংবর্ধনা ও দোয়া মাহফিল শৈলকুপায় আহত মেছোবাঘকে পিটিয়ে মারলো এলাকাবাসী কেশবপুরে যুবকের মরদেহ উদ্ধার লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ৯ জনকে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী স্বরূপকাঠি পৌর বিএনপির সম্মেলনে সভাপতি কামাল, সাধারণ সম্পাদক মাইনুল মানবিক বাংলাদেশ গড়তে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে —-মিয়া গোলাম পরওয়ার খুলনায় অস্ত্র ও গুলিসহ একজনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী
নোটিশ
যে সব জেলা, উপজেলায় প্রতিনিধি নেই সেখানে প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। বায়োডাটা সহ নিউজ পাঠান। Email: newssonarbangla@gmail.com

একটি দৃঢ় সংকল্প: ভালোবাসা এবং কঠোর পরিশ্রমের এক জীবন্ত গল্প

Reporter Name
Update : বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৫, ৭:৪৬ অপরাহ্ন
Oplus_131072

জীবনের বাঁকে বাঁকে সংগ্রাম:-
আমার জন্ম খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার গজেন্দ্রপুর গ্রামে। সালটা ছিল ২০০৭-০৮, আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে আমার ছোটবেলাটা ছিল হাসিখুশি আর প্রাচুর্যে ভরা। বাবা-মা দুজনেই এনজিওতে চাকরি করতেন। আমার জন্মদিনে প্রায় বিয়ের অনুষ্ঠানের মতো আয়োজন করা হতো। আমাদের এমন সচ্ছল জীবন দেখে অনেকেই অবাক হতেন।
আমার মা ১৯৯৪ সাল থেকে থুকড়ার জনতা বহুমুখী সমবায় সমিতির কর্মী ছিলেস এবং সাফল্যের সাথে চাকুরি জীবন পার করছিলেন। আমার মা অসংখ্য মানুষকে বিপদে-আপদে সাহায্য করতেন। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে একদিন সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেল।

এক দুর্ঘটনার পর এলোমেলো জীবন:-
বাইরের কিছু অসাধু লোক আমার মায়ের কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা লোন নেয়, যা তারা আর ফেরত দেয়নি। এর ফলে আমার মা ১০-১২ লক্ষ টাকার ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন। গ্রামের মানুষ এবং আত্মীয়-স্বজনের টাকাও সেখানে ছিল। এই বিশাল ঋণের চাপে বাবা আমার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।
মায়ের কাছে শুনেছি, তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে খুলনায় চলে যান। মামার বাড়িতেও জায়গা পাননি, কারণ পাওনাদাররা সেখানেও মায়ের খোঁজ করত। দিনের পর দিন রূপসা ব্রিজের নিচে না খেয়ে কাটিয়েছেন, পায়ে একজোড়া জুতোও ছিল না। খালি পায়ে হেঁটে, মানুষের কাছে চেয়ে একটি বিস্কিট বা চা খেয়ে দিন পার করতেন। এমন চরম দুর্দিনে অচেনা এক মহিলা, যিনি জুটমিলে কাজ করতেন, তিনি মাকে আশ্রয় দেন। তার সহায়তায় মা রূপসার একটি চিংড়ি মাছের কোম্পানিতে মাছ বাছাইয়ের কাজ পান এবং ছোটো একটি বাসা নিয়ে থাকেন। এই সামান্য আয়েই মা কোনোমতে দিন পার করতে লাগলেন।
এদিকে, বাবা আমাকে আমার মামার বাড়ি, ডুমুরিয়ার শোভনা ইউনিয়নের জিয়ালতলা গ্রামে রেখে এলেন। সেখানে আমার একটি মাসি ছিলো। আমার মাসির কাছে আমি বড় হতে থাকলাম। আমার মাসি হাটে কচু শাক, শাপলা, থানকুনি, ডিম বিক্রি করে আমাকে মানুষ করতে থাকে। স্কুলে ভর্তি করায়। পড়া লেখার খরচ চালায়। মামার বাড়িতে আমি বড় হতে থাকি৷ সেখানে বিলে গরু রাখতে যেতাম। সকালে গরু নিয়ে যেতাম আর সন্ধ্যায় ফিরতাম। এভাবে কোনো মতে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকি।
এরপর হঠাৎ একদিন শুনলাম আমার বাবা আরেকটি বিয়ে করে এনেছে। তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তখন সেটা জানতে পেরে আমার মা ও পাগল এর মতো হয়ে গেলো এবং সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ফিরে গেলো এবং দেখলো আমার বাবা সেই নতুন বৌয়ের সঙ্গে সংসার করছে। এটি যে একজন নারীর জন্য কতোটা কষ্টের সেটা শুধু সেই জানে যে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। আমার মাকে আবার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো।

নতুন করে জীবন গড়া:-
এরপর মা প্রদীপন নামের একটি এনজিওতে চাকরি পেলেন। যেহেতু মা আগে থেকেই এনজিওতে চাকুরি করতেন সেই যোগাযোগের সুবাদে চাকুরিটি পেয়ে গেলেন। পোস্টিং হলো খুলনা জেলার প্রত্যন্ত উপজেলা কয়রাতে। তখন আইলায় বিধ্বস্ত কয়রা উপজেলার অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। মায়ের মাসিক বেতন ছিল মাত্র ৬ হাজার টাকা। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় মা আমাকে তার কাছে নিয়ে গেলেন এবং স্থানীয় একটি হাইস্কুলে ভর্তি করালেন। আমার সাথে আমার মাসিকেও নিয়ে গেলাম।
কয়রা থেকে এসএসসি পাশ করে আমি নিজের গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাড়ির কাছেই সরকারি শাহপুর মধুগ্রাম কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলাম। যদিও বাড়ি থেকে মাত্র ৩-৪ কিলোমিটার দূরে ছিলাম, তবুও কখনো সেখানে ফিরতে পারিনি। কলেজের হোস্টেলে থাকতাম। ছুটির দিনে যখন সবাই বাড়ি যেত, আমি একা মন খারাপ করে বসে থাকতাম, কারণ আমার তো কোনো বাড়ি ছিল না। মাঝে মাঝে বাড়ির এলাকায় যেতাম। ১০ বছর পর যখন গ্রামে পা রাখি, ছোটবেলার স্মৃতিগুলো মনে পড়ছিল, কিন্তু বাড়িতে ঢোকার সাহস পাইনি। পাওনাদারদের ভয়ে সবার সামনে লুকায়ে থাকতাম, নিজের পরিচয়ও দিতাম না।

নতুন দিনের সূচনা:-
এরপর আমার বাবা একটু একটু করে আমার খোজ খবর নিতে শুরু করে। ততোদিনে শুনি আমার বাবা যে মহিলাকে বিয়ে করে আনছিলো সেখানে একটি ছেলে হয়েছে এবং সেই মহিলা অন্য একটি পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে গেছে ছেলে রেখে। তখন বাবা আমার খোজ খবর নেওয়া বা যত্ন নিতে শুরু করে। তার আগের সম্পূর্ণ Journey টা ছিলো আমার, মাসির আর আমার মায়ের।
এইচএসসি পাশ করার পর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য খুলনায় চলে এলাম। মাও চাকরি ছেড়ে আমার সঙ্গে চলে আসলেন। আর্থিক সংকটের কারণে একটি প্রাইভেট কোচিং-এ কম টাকায় ভর্তি হলাম। সেই দিনগুলোও ছিল অনেক কঠিন। এমনও দিন গেছে, যখন মায়ের হাতে মাত্র ৭ টাকা ছিল। রূপসার লবণচরা থেকে আজম খান কমার্স কলেজের পাশের কোচিং-এ যেতে প্রতিদিন ৩০ টাকা লাগতো। সেদিন ৫ টাকা দিয়ে ট্রাফিক মোড় পর্যন্ত গিয়ে বাকি পথ হেঁটে যেতাম এবং ফেরার সময় পুরো পথ হেঁটে আসতাম।
টাকার অভাবে বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফর্ম তুলতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়েটিং লিস্টে ছিলাম এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্টে সুযোগ পেলাম। কিন্তু সেখানে আবাসিক হলের তেমন ব্যবস্থা না থাকায় ভর্তি হইনি। অবশেষে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভালো মেধাস্থান নিয়ে ভর্তি হলাম। কিন্তু ক্লাস শুরুর পর পরই করোনা মহামারী সবকিছু এলোমেলো করে দিল।

ফ্রিল্যান্সিং এবং সাফল্যের পথ:-
করোনার পর আমি আবার খুলনায় ফিরে এলাম। মা একটি ছোট সমিতিতে চাকরি করতেন। আমি কয়েকটি টিউশনি শুরু করলাম এবং মোবাইলে ভিডিও দেখে ফ্রিল্যান্সিং শিখতে লাগলাম। SEO, Web design, Graphics design এবং Data entry-এর কাজ শিখে একটি সমিতির থেকে ৪৫ হাজার টাকা লোন নিয়ে একটি ল্যাপটপ কিনলাম। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ শুরু করে আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করলো।
এক পর্যায়ে দেখলাম ফ্রিল্যান্সিংয়ে বেশি সময় দিলে আমার একাডেমিক পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। তাই আমি ফ্রিল্যান্সিং কমিয়ে ইংরেজি ভাষার ওপর বিভিন্ন কোর্স করতে লাগলাম। ফ্রিল্যান্সিং থেকে জমানো টাকা দিয়ে IELTS পরীক্ষা দিলাম এবং ৮.০০ ব্যান্ড স্কোর অর্জন করলাম। এরপর আমি নিজেই অনলাইনে এবং অফলাইনে স্পোকেন ইংলিশ, ফ্রিহ্যান্ড রাইটিং ও IELTS-এর ক্লাস নেওয়া শুরু করলাম।

এই সময়েই আমার জীবনে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটলো। আমাকে যিনি বড় করেছেন, সেই মাসি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমাদের হাতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় ভালো চিকিৎসা করাতে পারলাম না। এক ভোরে আমার মাসি আমার হাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ৪৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান। সেদিন চিৎকার করে কাঁদছিলাম আর ভাবছিলাম, যদি আমার কাছে অনেক টাকা থাকতো, তাহলে হয়তো মাসিকে আরও ভালো চিকিৎসা করাতে পারতাম। তিনি আমাকে মানুষ করার জন্য সারাজীবন বিয়ে করেননি। নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে আমাকে বড় করে তুলেছিলেন।

স্বপ্নপূরণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
মাসির মৃত্যুর পর আমি উপলব্ধি করলাম যে জীবনে টাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি শপথ নিলাম, সৎ পথে থেকে কঠোর পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করবো, যাতে আর কোনো অসহায় মানুষকে আমার চোখের সামনে মরতে দেখতে না হয়। এরপর দিন-রাত পরিশ্রম করতে শুরু করলাম।
আমার ইংরেজি শেখানোর কৌশল অনেকের মন জয় করলো। দেশ-বিদেশের বহু মানুষ আমার কোর্সে ভর্তি হতে লাগলেন। ছাত্র অবস্থাতেই আমার মাসিক আয় ২-৩ লক্ষ টাকা হতে থাকলো। একই সাথে আমার একাডেমিক পড়াশোনাও ঠিক রাখলাম।
২০২৩ সালে আমি প্রায় ৮-১০ লক্ষ টাকা জমিয়ে মায়ের সেই ১৬ বছরের পুরোনো ঋণ শোধ করলাম। সেই গ্রামে গিয়ে যাদের টাকা বাকি ছিল, তাদের হাতে টাকা পৌঁছে দিলাম এবং মায়ের হয়ে ক্ষমা চাইলাম। সেই মুহূর্তে যে সুখ অনুভব করেছিলাম, তা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল। এরপর মাকে নিয়ে ১৬ বছর পর সেই গ্রামে গেলাম। আর ২০২৪ সালে সেই গ্রামে প্রায় ২২-২৩ লক্ষ টাকা খরচ করে একটি বাড়ি তৈরি করলাম, যা আমার জীবনের আরেকটি বড় অর্জন।

বর্তমানে আমি অনলাইনে এবং অফলাইনে প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থীকে ইংরেজি ভাষার কোর্স করাই।
অফলাইনে আমি Daffodil international university, Foreign ministry এর Project, Bangladesh Education board, Bangladesh Army university সহ বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষার প্রশিক্ষণ প্রদান করেছি।
আমার ছাত্ররা স্পোকেন ইংলিশ এবং IELTS কোর্স সম্পন্ন করে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ব্রুনাই, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, হংকং, এবং কাতার থেকেও অনেক প্রবাসী ভাই-বোন আমার কাছে কোর্স করছেন।
আমার নিজের লেখা একটি স্পোকেন ইংলিশ বইও প্রকাশিত হয়েছে, যার নাম “Speak English With সোনামুখ”। এই বই লেখার জন্য আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন সোনামুখ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা এ.এম. কামরুল ইসলাম। তিনি আমাকে সম্মান, মর্যাদা এবং সত্যিকারের পিতৃস্নেহ দিয়েছেন, যা আমার জীবনের এক অমূল্য প্রাপ্তি।

সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা:
আজ আমার প্রতিষ্ঠানে ২২-২৩ জন বেকার ছেলেকে চাকরি দিতে পেরেছি। তারা ডিজিটাল মার্কেটিং সহ বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছে এবং নিয়মিত বেতন পাচ্ছে। যখন তাদের বাবা-মায়েরা আমাকে ফোন করে বলেন, “বাবা, তোমার জন্য আজ আমাদের পরিবারটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে,” তখন মনে হয় আমি সত্যিই সফল।
আজ সব কিছু থাকলেও সেই মাসি নেই, যিনি আমাকে বড় করেছেন। তিনি আমার এই সফলতা দেখে যেতে পারলেন না। এটি আমাকে এখনো কষ্ট দেয়।
আমি সমাজের জন্য এবং মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। আমার স্বপ্ন আমার নিজ এলাকা ডুমুরিয়া সহ অত্র অঞ্চলে যারা বিদেশে যেতে চায় বা IELTS করতে চায়, কিন্তু সঠিক পরিবেশ বা আর্থিক সমস্যার কারণে পিছিয়ে আছে, তাদের বিনামূল্যে Communicative Language শিখাবো। হাজার হাজার টাকা খরচ করে কোর্স করার সামর্থ্য যাদের নেই, আমি তাদের পাশে থাকতে চাই। বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের ইংরেজি শেখার স্বপ্ন আমি পূরণ করতে চাই। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।

সৌমেন মণ্ডল
১৪.০৮.২০২৫


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Theme Created By Uttoron Host