মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৮ পূর্বাহ্ন
নোটিশ
যে সব জেলা, উপজেলায় প্রতিনিধি নেই সেখানে প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। বায়োডাটা সহ নিউজ পাঠান। Email: newssonarbangla@gmail.com

বিশ বছর ধরে আলো ছড়াচ্ছে গ্রামীণ পাঠাগার

রয়েল আহমেদ, শৈলকুপা (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি
Update : সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৭:৩৭ অপরাহ্ন

রয়েল আহমেদ, শৈলকুপা (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি : গ্রামে কোনো স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা নেই। নেই কোনো খেলার মাঠ। গ্রাম থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুরত্ব ২ কিলোমিটার। হাই স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজের দুরত্ব ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা না থাকলেও এ গ্রামে রয়েছে একটি পাঠাগার। ২৫ ডিসেম্বর পাঠাগারের ২০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে চলছে প্রস্তুতি। পাঠাগারের চারপাশ ঘিরে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গ্রামে সাজ সাজ রব। প্রত্যেক বাড়িতেই উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। ঈদের সময়ের মতো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রামের ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। এ গ্রামের প্রায় শতভাগ ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করে, গ্রামে কোনো বেকার নেই বললেই চলে। স্বল্প শিক্ষিতরাও ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় চাকুরি বা ব্যবসা বাণিজ্য বাকিরা পড়ালেখা করে। গ্রামের ছেলে মেয়েরা পাশ্ববর্তী গ্রামের স্কুলে যায়, খেলাধুলার মাঠ না থাকায় তারা পাঠাগারে বসে বই, পত্রিকা পড়েই সময় কাটায়। রাতে হয় গানের চর্চা। কেউ কেউ বাড়িতেও বই নিয়ে যায়। এখানে বসে বই পড়তে যেমন কোনো বাঁধা নেই, বাড়িতে নিয়ে বই পড়তেও কোনো ফি জমা দিতে হয় না। শুধুমাত্র খাতায় এন্ট্রি করতে হয়। শৈলকুপা উপজেলা সদর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে পৌরসভা হলেও একেবারেও পাড়াগাঁ, ছোট পিচঢালা রাস্তা ধরে এগোলে মাঠের মাঝখানে একটি স্মৃতিফলক চোখে পড়বে। গ্রামে আগত মানুষকে স্বাগত জানাতে এটি নির্মান করা হয়েছে। স্মৃতিফলকটি গ্রামের দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। একটি বেদীর উপর টাইলস দ্বারা স্মৃতিফলকটি যে কারো নজর কাড়বে। বুঝতে বাকি থাকবে না এ গ্রামে সৃজনশীল মানুষ বসবাস করে। আর একটু এগিয়ে গেলেই ছোট্ট একটি টিনের ঘর, ঘরের পাশেই রাস্তাঘেঁষে একটি কামিনী ফুলের গাছের গোড়ায় পাকা করা বেদী। সকালে বিকালে এখানে ছেলে বুড়ো বসে বিশ্রাম নেয়। বই পড়ে, পত্রিকা পড়ে, মোবাইলে ফেসবুক দেখে, কেউ গেম খেলে। ঘরটি বাইরে থেকে দেখলে বুঝার উপায় নেই এখানে কি আছে? কিন্তু দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেই বুঝা যাবে এখানে থরে থরে সাজানো জ্ঞানের ভান্ডার। ৭ টি আলমারি ভরা আছে উপন্যাস, কবিতা, গল্প, মুক্তিযুদ্ধ, গবেষণা, ইতিহাস, ঐতিহ্যের বই। মাঝখানে বসানো দুটি লম্বা টেবিল, একটি গোলটেবিল, টিনের বেড়ার সাথে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তের ছবি, বীরশ্রেষ্ঠদের ছবিও আছে। সারি করে রাখা চেয়ারে বসে আছেন কয়েকজন পাঠক। কেউ বই পড়ছেন, কেউ দৈনিক সংবাদপত্র, কেউবা সাময়িকী। ২০ বছর ধরে এভাবেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে শৈলকুপার প্রত্যন্ত পল্লীর বিএসডি ক্লাব এন্ড পাঠাগার । শৈলকুপা উপজেলা শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় পাঠাগারটি অবস্থিত। ২০০৪ সালে স্কুল পড়ুয়া ছোট ছোট ছেলেরা নিজেদের উদ্যোগে পাড়ার পরিত্যাক্ত একটি জায়গায় ছোট্ট একটি টিনের ঘর তুলে চাটাই এর বেড়া দিয়ে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয় বিএসডি ক্লাব নামে।

কয়েকবছর পর এটিকে বিএসডি ক্লাব এন্ড পাঠাগার নামকরণ করা হয়। সংগ্রহ করা হয় বইয়ের তাক, চেয়ার টেবিল ও বই। প্রাথমিকভাবে বর্তমান সভাপতির সংগ্রহ থেকে তিন শতাধিক বই নিয়ে শুরু হয় পাঠাগারের কার্যক্রম। পরে অন্যদের সংগ্রহে থাকা আরও ২ শত বই নিয়ে গড়ে তোলা হয় পাঠাগারটি। এভাবেই শুরু। ২০১৩ সালে বেসরকারি গ্রন্থাগার উন্নয়ন প্রকল্পের অধিনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় পাঠাগারটিকে এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা অনুদান বরাদ্দ দেয়। শর্ত থাকে ৫০% টাকার বই ও আসবাবপত্র বাবদ ৫০% টাকা খরচ করা যাবে। পাঠাগারটির রেজিষ্ট্রেশন না থাকায় চেকটি আটকে দেন তৎকালীন ইউএনও। পরে কিছুদিনের মধ্যে রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন করে চেকটি সংগ্রহ করা হয়। শুরু হয় নবউদ্যোমে কর্মকাণ্ড। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ৫০% টাকা খরচ করে নতুন ঘর নির্মান করা হয়। বাকি টাকায় ঢাকা থেকে নতুন বই কেনা হয়। শুরু হয় নতুন করে পথচলা। গ্রামের কৃতিসন্তান ঢাকা ওয়াসার সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা গ্রামে এসে পাঠাগারটি পরিদর্শন করে অভিভূত হন। তিনি কিছু আর্থিক অনুদান দেন এবং পাঠাগার এর কার্যক্রমকে প্রশংসা করে পাঠাগারের সাথে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেন। তার সফরসঙ্গী পাশের গ্রামের আর একজন প্রকৌশলী এএস এম আনিসুজ্জামান তিনিও কিছু আর্থিক অনুদান দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসেন। এতে আরো গতি বেড়ে যায় কর্মদ্যোমী তরুণদের। আর থেমে থাকেনি। সরকারি বেসরকারি ছোট ছোট অনুদানে নিজেদের চাদার টাকায় গড়ে ওঠে পাঠাগারটি। বিভিন্ন সময় উপজেলা নির্বাহী অফিসার, এসিল্যান্ড, এলাকার গুনীজনরা পাঠাগার ঘুরে গেছেন। বর্তমানে এ গ্রন্থাগারের সংগ্রহে রয়েছে ২ হাজারের অধিক বই। মোট বইয়ের ৫০ শতাংশই উপন্যাস, গবেষণাগ্রন্থ আছে ২০ শতাংশ, বাংলাদেশ ও বিশ্বের ইতিহাস ও ঐতিহ্যভিত্তিক বই আছে ১০ শতাংশ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই আছে ১০ শতাংশ। বই ছাড়াও পাঠকদের চাহিদা মিটাতে প্রতিদিন ৩টি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা এবং ২টি সাময়িকী নিয়মিত রাখা হয়। নিয়ম করে প্রতিদিনই খোলা রাখা হয়। পাঠাগার। প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফার নামে একটি শিক্ষাবৃত্তি প্রকল্প চালু আছে। পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতি বছর ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ১৫ জনকে দেওয়া হয় শিক্ষাবৃত্তি। এ উপলক্ষে বছরে তিনটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বছরান্তে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এর আয়োজন করা হয়। বইপড়া কর্মসূচি চালু আছে। প্রতিবছর সেরা পাঠককে দেওয়া হয় পুরস্কার। পাঠাগার পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আলমগীর অরণ্য বলেন, গ্রামে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা না থাকলেও পাঠাগারটির মাধ্যমে আমরা শিশু কিশোরদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার নিরলস কাজটি চালিয়ে যাচ্ছি। এখন গ্রামের ছেলেমেয়েরা বই পড়ে। পাঠাগারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় সেখানে ছেলে মেয়েরা অংশ গ্রহণ করে। এ সুযোগ আগে ছিল না। গ্রামের মানুষের মধ্যে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে এটাই স্বার্থকতা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Theme Created By Uttoron Host