আমি সৌমেন মণ্ডল, সোনামুখ পরিবারের একজন সদস্য। আমার এই পরিবারের সঙ্গে পথচলা শুরু হয় ২০২৪ সালের ৯ই নভেম্বর। তার আগের দিনেই আমি আমার নিজের বাড়ির ছাদ ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন করি। এই দিনটি আমার জন্য একটি স্বপ্নপূরণের দিন ছিলো কারণ আমি ছাত্র থাকা অবস্থায় নিজের ইনকামের টাকায় একটি বিল্ডিং তৈরি করেছি এবং সেটির ছাদ ঢালাই দিয়েছি। ছোটো বেলা থেকেই আমার জীবন ছিলো একটি দীর্ঘ সংগ্রামের অধ্যায়।
সোনামুখ পরিবারের সঙ্গে পথচলার সূচনা:-
৯ই নভেম্বর সকালে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে হঠাৎ একটি ফোন কল আসে। ফোনের ওপার থেকে শ্রদ্ধেয় এ.এম. কামরুল ইসলাম আঙ্কেল আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি আমাকে চেনো?” আমি কিছুটা অবাক হয়ে গেলেও দ্রুত উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ স্যার, আমি আপনাকে চিনি। আপনি সোনামুখ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা।” তিনি তখন আমাকে বলেন, “তুমিই আমার সোনামুখ।” এই কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। এরপর তিনি আমাকে পরের দিন আমার মাকে নিয়ে শাহাপুরের আই.এল.এস.টি-তে যেতে বলেন।
পরের দিন সেখানে গিয়ে আমি সোনামুখ পরিবার কর্তৃক আয়োজিত ‘সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণ’ নামের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেই। সেখানে বাংলাদেশের বিখ্যাত শিক্ষক প্রশিক্ষক জনাব নুরুজ্জামান ফিরোজ স্যার উত্তর ডুমুরিয়ার বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। তাঁর শিক্ষণ পদ্ধতি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই।
এরপর কামরুল ইসলাম আঙ্কেল আমাকে মঞ্চে ডেকে আমার জীবন সংগ্রামের গল্প এবং সাফল্যের ইতিহাস শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে বলেন, যাতে তারা অনুপ্রাণিত হতে পারে। আমি আমার মাকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে উঠে আমার জীবনের কথা তুলে ধরি।
↘️↘️ আমার জীবন সংগ্রামের উপন্যাস এবং সফলতার গল্পটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:-
https://docs.google.com/document/d/1aTldYUOC9xOKz8RSQPr7pHInHFcY_eIhEXhU-iNL4aw/edit?tab=t.0
একটি নতুন স্বপ্নের জন্ম: শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বজয়:-
অনুষ্ঠান শেষে বাসে করে ফেরার পথে আমি গ্রামের ছেলে-মেয়েদের মেধা দেখে অবাক হয়ে যাই। নুরুজ্জামান ফিরোজ স্যারের প্রশিক্ষণে তাদের হাতের লেখা, স্বরচিত ছড়া এবং উপস্থিত বক্তৃতা ছিল অসাধারণ। তখনই আমার মনে হয়, এই শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু একটা করা উচিত।
আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, আমি তাদের ইংরেজিতে দক্ষ করে তুলব, যাতে তারা সোনামুখের সুনাম দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে পারে। আমি আমার এই স্বপ্নের কথা কামরুল ইসলাম আঙ্কেলকে জানালে তিনি আমাকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। আমি তাদের English এ Expert এবং Fluent করে গড়ে তুলবো যাতে করে তারা এই সোনামুখের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের বুকে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয় এবং আমি আমার স্বপ্নগুলো শেয়ার করলাম সোনামুখ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধেয় এ.এম. কামরুল ইসলাম আঙ্কেলের সঙ্গে। এছাড়া সেখানকার শিক্ষার্থীদের জন্য সোনামুখের নাম দিয়ে আমি Spoken English এর একটি বই লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম যাতে করে সেটি পড়ে তারা প্রত্যেকেই ইংরেজিতে দক্ষ হতে পারে। আমি সেই স্বপ্নের কথা কামরুল ইসলাম আঙ্কেলকে জানাতেই তিনি আমাকে সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা করলেন এবং বই তৈরির জন্য সঙ্গে সঙ্গে এক লক্ষ টাকা পাঠিয়ে দিলেন। আমি ১০০০ কপি বই তৈরি করলাম।
৬ দিনের ‘ইংলিশ অলিম্পিয়াড’ এবং এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন:-
এরপর ২০২৫ সালের ৮ই ডিসেম্বর, আমার স্বপ্ন পূরণের এই পথটি তৈরি করে দেন তিনি। তিনি ৬ দিনের একটি English Olympiad-এর আয়োজন করেন, যেখানে আমি প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলাম। আমার প্রশিক্ষণ পেয়ে আশ্চর্যজনকভাবে, মাত্র ৬ দিনের মধ্যেই সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করে। সেই অনুষ্ঠানে আমার লেখা বইটি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। আমি সেখানে ঘোষণা করি যে, বই বিক্রির সম্পূর্ণ লাভ সোনামুখ পরিবারের ছেলে-মেয়েদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।
আশ্চর্যজনকভাবে, মাত্র দুই মাসের মধ্যেই ১০০০ কপি বই বিক্রি হয়ে যায় এবং আমি বই বিক্রির লাভ থেকে দেড় লক্ষ টাকা শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানের জন্য সোনামুখ পরিবারে দিয়ে আসি। এরপর আমরা বইটির একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করি, যা কামরুল ইসলাম আঙ্কেলের একান্ত প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে। নতুন বইটি আরও উন্নত হওয়ায় এর বিক্রিও অনেক ভালো হচ্ছে। এই বইটির প্রচ্ছদ ডিজাইন ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন জনাব নুরুজ্জামান ফিরোজ স্যার।
সোনামুখের বিস্তৃত কার্যক্রম ও দূরদর্শী নেতৃত্ব:
পরবর্তীতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আমরা প্রতি মাসে ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, কৃষি, কম্পিউটার, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবো। প্রতি মাসে এই আয়োজনে দেশের খ্যাতনামা অধ্যাপক ও গুণীজনেরা অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন এবং শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তাদের জ্ঞানগর্ভমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন:
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াইহা আক্তার ( ভাইন চ্যান্সেলর, চট্টগ্রাম বিশ্বিদ্যালয়)
ড. আনোয়ার এইচ জোয়ার্দার
* অধ্যাপক মাজাহারুল হান্নান
* অধ্যাপক ড. শাহ আলম
* আমেরিকান প্রবাসী অধ্যাপক ড. সালাম আজাদ
* ড. সন্দিপক মল্লিক
* জনাব মুহাম্মদ আলামিন, ইউএনও ডুমুরিয়া উপজেলা সহ প্রমূখ ব্যক্তিত্ব
এছাড়াও, সোনামুখ পরিবার ডুমুরিয়া উপজেলার সকল মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি বাংলা ও ইংরেজি বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। এটি ছিল সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের একটি অনুষ্ঠান, যেখানে শুধুমাত্র সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণের শিক্ষার্থীরাই ইংরেজি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিবেট ফেডারেশনের সদস্য এস এম মোসাব্বির হোসাইন এই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। এই বিতর্ক প্রতিযোগিতা এবং সোনামুখের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি উপস্থাপনা দেশ-বিদেশের বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যা সোনামুখ পরিবারের জন্য একটি বড় সাফল্য।
মানুষ গড়ার কারিগর: এ.এম. কামরুল ইসলামের অনন্য উদ্যোগ:-
এছাড়া সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে আলাদা ইউনিফর্ম। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশে তৈরি করা হয়েছে “সোনামুখ স্বপ্নচারা ফাউন্ডেশন” নামের একটি সংগঠন। যেখানে শিক্ষার্থীরাই প্রতি মাসে মিটিং করে তাদের নিজেদের বৃত্তির টাকা তারা নিজেরাই বণ্টন করে উপযুক্ত ছাত্র/ছাত্রীকে দেয়, যেটি স্থাপন করেছে আরেকটি অনন্য দৃষ্টান্ত।
এভাবেই এগিয়ে চলছে জনাব এ.এম. কামরুল ইসলামের হাতে গড়া সোনামুখ প্রতিভা অন্বেষণ। আন্দুলিয়া গ্রামের ইসমাইল আকুঞ্জি ও শ্লোক নেছা বিবি পুকুর ঘাট থেকে গড়ে উঠছে এক একটি সোনামুখ।
বহু সৃজনশীল ও মানবিক কর্মকাণ্ডের, বৃহৎ পরিসরে বিস্তৃত এবং পরিবেশ, প্রাণী ও মানব কল্যাণে কাজ করা এই স্বেচ্ছাসেবামূলক সামাজিক সংগঠনটির নাম “সোনামুখ পরিবার”।
‘যেহেতু ভালো কাজের মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত’, তাই এর স্লোগান হলো:
> “আমরা সবাই সোনামুখ,
> ভালো কাজে মোদের সুখ।
> সোনামুখ পরিবার,
> মানুষ গড়ার কারিগর।”
প্রফেসর সাধন রঞ্জন ঘোষ স্যারের মন্তব্য, “সোনামুখের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে হবে। তাদের বাইরেরটা নয়, ভেতরটা সোনা দিয়ে মোড়ানো। যারা স্বপ্ন দেখতে জানে এবং স্বপ্ন দেখাতে পারে, যারা পথে নামতে জানে এবং পথ গড়তে জানে। কামরুল ইসলাম তাঁর সারাজীবনের সাধনা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে রূপায়িত করবার সুতীব্র বাসনা থেকে ‘সোনামুখ’ গড়ে তুলেছেন।”
এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সোনামুখ পরিবারের বৃহৎ কর্মযজ্ঞ বর্তমানে যেমন চলছে, আগামীতেও আরো বৃহৎ পরিসরে চলমান থাকবে।
সৌমেন মণ্ডল
১৪.০৮.২০২৫