রয়েল আহমেদ, শৈলকুপা, (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধিঃ ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার নিত্যানন্দপুর ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী আশুরহাট। গ্রামটি এখন সকলের কাছে ‘পাখির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত। প্রায় সারাবছর এখানে পরীযায়ী পাখির কলরব গ্রামবাসীকে আনন্দ দেয়। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসে পাখি দেখতে। গাছে গাছে বড় বড় শামুকখোল, বালিহাস, পানকৌড়িসহ দেশীয় নানান পাখির উড়াউড়ি, পাখা ঝাপটানো, কিচিরমিচির দেখে আনন্দ পায় আগত দর্শনার্থী। পাখির কলকাকলিতে সবসময় মূখর থাকে এলাকাটি। প্রায় একযুগ আগে ১০ একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠে পরিযায়ী পাখির এ অভয়ারণ্য।
গ্রামের মাঝখানে পুরনো দুটি বড় বড় পুকুর এর পাড়ে ঝোপ জঙ্গলে ঘেরা শিমুল, মেহগণি, জামসহ বিভিন্ন জাতের বৃক্ষ এদের আশ্রয় স্থল। প্রতিদিন গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙে পাখির কলকাকলীতে । গাছের ডালে ডালে পাতায় পাতায় যেন পাখির বাসা। হাজার হাজার পাখির কলোনীতে পরিনত হয়েছে গ্রামটি। নিত্যানন্দপুর বাওড়, বিল সহ বেশ কয়েকটি জলাশয় রয়েছে এ অঞ্চলে। যেখানে সারাবছর পানি ও পাখির খাদ্যের নিশ্চয়তা থাকে। প্রাকৃতিকভাবে পাখিদের খাবার ও নিরাপদ আশ্রয় এর বন্দোবস্ত থাকায় কয়েকবছর আগে থেকে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি এ গ্রামে আসা-যাওয়া শুরু করে। ২০১৩ সাল থেকে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে পাখিগুলো। বর্ষার আগমনের সময় এরা সূদুর সাইবেরিয়া থেকে উড়তে উড়তে চলে আসে বাংলাদেশে। নাতিশীতষ্ণ এ অঞ্চলে এসে এরা নতুন করে বাসা বাধে। নতুন বাসায় ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা ফুটায়। বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত পর্যন্ত এরা এখানে থাকে। শীত শেষে গ্রীষ্মের শুরুতে এ এলাকায় খাবার এর সংকট দেখা দেয় তখন এরা বাচ্চা কাচ্ছা নিয়ে অন্যত্র চলেও যায়। কিছু পাখি থেকে যায় এ কলোনীতে।
২০১৩ সালে পাখি সুরক্ষায় জেলা প্রশাসনের নির্দেশে শৈলকুপা উপজেলা প্রশাসন গ্রামটিকে পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। দুটি সাইনবোর্ড টানিয়ে পাখি শিকার ও পাখিকে ডিস্টার্ব না করার জন্য সতর্কতা করা হয়। পাশাপাশি পাখিদের সুরক্ষায় স্থানীয়ভাবে পাহারাদারের ব্যবস্থাও করা হয়। এর পর থেকে ধীরে ধীরে আশুরহাট গ্রামটি ‘পাখির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। গাছে গাছে বাসা বেঁধে অবস্থান করতে থাকা পাখিগুলোর সৌন্দর্যে গ্রামটির সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পায় অনেকগুণ।
সরেজমিন আশুরহাট গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের মধ্যপাড়ার আব্দুর রাজ্জাক ও গোপাল চন্দ্র বিশ্বাসের পুকুরপাড়ের শিমুল, জাম ও মেহগনি গাছের ডালে ডালে বাসা বেঁধেছে হাজারো পাখি। উপযুক্ত আবহাওয়া ও পর্যাপ্ত খাবারের জোগান থাকায় পাখিগুলো এখানে গড়ে তুলেছে স্থায়ী রাজ্য। তবে শুরুর দিকে নানারকম হুমকির মুখে পড়তো অতিথি পাখি। শিকারির চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হতো তারা। কেউ কেউ গাছে উঠে বাচ্চা চুরি করতো, অনেক সময় ঝড়, বাতাসে বাসা থেকে বাচ্চা পড়ে গেলে সেগুলো গোপনে কেউ সংগ্রহ করে নিজেরা মাংশ খেত বা অন্যত্র বিক্রি করে দিত। এসব মিলে বেশ অনিরাপদ ছিল পাখিগুলো। সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠেছে এলাকাবাসীর সচেতনতায়। পাখি গ্রামের মানুষের লাভের চেয়ে ক্ষতিই করে বেশী। দলবেধে পাখি ক্ষেতের মধ্যে খাবার অনুসন্ধান করতে গিয়ে ফসল নষ্ট করে, পুকুরের মাছ ধরে উদরপূর্তি করে, পাখির বিষ্টার কারনে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়ায় তবুও এলাকাবাসী পাখির প্রতি একধরনের মমতাবোধ কাজ করে। তাই তারা পাখির কোনো ক্ষতি করেনা, কাউকে ক্ষতি করতে দেয়না। নিভৃত পল্লীর গ্রামটি পাখির জন্য আজ সারাদেশে পরিচিতি পেয়েছে। গ্রামবাসীর ভালোবাসার কারনে বাইরে থেকে আসা কোনো শিকারী এখন আর পাখি শিকার করতে সাহস করেনা। পাখির নিরাপদ আশ্রয় সুরক্ষার জন্য গ্রামবাসীর উদ্যোগে এখানে পাখি সংরক্ষণ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এত উদ্যোগের পরও মাঝে মাঝে বিপত্তি ঘটে। নিজেদের প্রয়োজনে জমির মালিকরা মাঝে মাঝে গাছ কেটে ফেলে, ঝোপঝাড় পরিস্কার করে, রাতের বেলা কিছু শিকারির চোরাগোপ্তা হামলাও হয় বলে অভিযোগ আছে। এতে হাজার হাজার পাখির কলতানে মুখরিত অভয়ারণ্যটি পাখি শূন্য হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। অভয়ারণ্যের মধ্যে থাকা গাছ কাটা ও পাখি শিকার বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দা সফর আলী জানান, জমির মালিকরা মাঝে মধ্যে গাছ কাটেন। এভাবে গাছ কাটার কারণে পাখিদের আবাসন সংকট দেখা দেবে। সেই সঙ্গে পাখি শূন্য হয়ে পড়বে এই অভয়ারণ্য। আশুরহাট পাখি সংরক্ষণ সমিতির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এভাবে গাছ কাটলে অতিথি পাখিরা এসে কোথায় থাকবে। আমি জেলা প্রশাসক ও ইউএনও বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছি। এই মুহূর্তে গাছ কাটা বন্ধ না করতে পারলে ভবিষ্যতে অতিথি পাখিসহ অন্যান্য পাখি এই এলাকায় আসবে না। পাখিশূন্য হয়ে পড়বে উপজেলার একমাত্র অভয়ারণ্য।