মোঃ আনোয়ার হোসেন আকুঞ্জী, খুলনা ব্যুরো॥ খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার থুকড়া গ্রাম। এক সময়ের আলোকিত জনপদ, এখন পরিচিতি পাচ্ছে ‘মাদকপুরী’ নামে। প্রায় ৪ হাজার ভোটার সম্বলিত এই গ্রামটি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের অবদান দিয়ে গর্বিত। কিন্তু দীর্ঘদিনের মাদক ব্যবসা ও সেবনের কারণে বর্তমানে আতঙ্কের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিড়ি-সিগারেট আর গাঁজা দিয়ে শুরু হওয়া নেশার সংস্কৃতি আজ বিস্তার লাভ করেছে ফেন্সিডিল, হেরোইন, ইয়াবা, আ্যালকোহল ও মদের মতো ভয়ঙ্কর নেশায়। সম্প্রতি বিষাক্ত মদপানে দুই যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় গ্রামটি পরিণত হয়েছে আতঙ্কের জনপদে।
খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ২৪০ গ্রামের একটি নাম থুকড়া। এখানকার ভোটার সংখ্যা প্রায় হাজার। সাড়ে ৫ হাজার মানুষের এই গ্রামে শিক্ষা বিস্তারে দুইটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি দাখিল মাদরাসা, কিন্ডারগার্টেন ও প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই গ্রামেই আছে মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর ও শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক সরদার আঃ হান্নান, চেয়ারম্যান হাসেম আলী বিশ্বাস, চেয়ারম্যান আঃ মতলেব সরদার, চেয়ারম্যান গাজী তফসির, নূর মোহাম্মদ সরদার, ৫জন মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্যা গুণীজনের জন্মস্থল এই থুকড়া। তবু সর্বনাশা মাদকের ছোবল এ গ্রামকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের পথে।
১৮ জুলাই রাতে বিষাক্ত আ্যালকোহল পান করে মারা যান জামিরুল ইসলাম সরদারের ছেলে রাসেল সরদার (২৮) ও রেজওয়ান গাজীর ছেলে রবিউল ইসলাম (৩২)। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এনামুল হক (২৮), মুকুল বিশ্বাস (২৭) এবং রবি সরদার (৩৫)। অসুস্থ এনামুল জানান, আমরা তিন বন্ধু বাজারের পাশে বসে এক বোতল মদ পান করি। সকালে বমি ও চোখে ঝাপসা দেখা শুরু হয়। তারা অভিযোগ করেন, এসব মদ এসেছে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী আঃ হালিম সরদারের কাছ থেকে।
থুকড়া বাজারের চিহিৃত কয়েকটি স্থানে সন্ধ্যায় বসে মাদকের হাট। সুনশান পরিবেশে থুকড়া চাতাল, মাদরাসা মোড়, পানির ট্যাংকি, প্রাইমারি স্কুল ও শান্তিনগরসহ কয়েকটি স্পটে চলে মাদক বেচাকেনা। স্থানীয় সেবনকারীদের ভাষ্য- টাকা ছাড়া অন্য কোনো কিছুই মাদক ব্যবসায়ীদের বিবেচনায় আসে না। এমনকি কিশোর বয়স থেকেই অনেকে নেশায় জড়িয়ে পড়ছে।
বর্তমানে ইয়াসিন কারা ভোগ করছে। প্রায় অধিকাংশরা এলাকায় বহাল তবিয়াতে থাকলেও তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। বিষাক্ত আ্যলকোহল সেবক অসুস্থ বুলবুল (৫০) বলেন,“হাফপ্যান্ট পরা সময় থেকে সখ করে নেশা করি। কিন্তু এ রকম বিষাক্ত মদ কখনও খাইনি। বিক্রেতা আঃ হালিম সরদারের কাছ থেকে আমি নেশা কিনে আনি। সারাদিন কাজকর্ম শেষে রাতে বাড়িতে বসে নেশা পান করি। এই বিষমদ খেয়েই থুকড়া গ্রামের রাসেল সরদার (২৮) ও রবিউল ইসলাম (৩২) মারা গেছে। স্থানীয়রা জানান, হালিম সরদার ও তার ঘনিষ্ঠ একটি চক্র বহু বছর ধরে মদ ও মাদক ব্যবসায় জড়িত। মাদকসহ গ্রেপ্তার হলেও দ্রুত জামিনে বের হয়ে আবারও শুরু হয় একই কারবার। পুলিশের তৎপরতার দাবি থাকলেও কার্যকর নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ খুব একটা নেই। রঘুনাথপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই ইব্রাহিম বলেন, দুইজন মারা গেলেও থানায় কেউ অভিযোগ করেনি। ডুমুরিয়া থানার ওসি মাসুদ রানা জানান, মাদক দমনে পুলিশ সবসময় তৎপর রয়েছে।
থুকড়া গ্রামের জি এম শফিকুর রহমান বলেন, আমরা মাদক ব্যবসায়ী ও সেবকদের কাছে অত্যন্ত দুর্বল। কয়েকজনের নাম প্রকাশ করে বলেন মাদক ক্রেতা ও বিক্রেতারা তাদের ছত্রছায়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কৃষি ও ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থের বড় অংশ খরচ হচ্ছে মাদক কিনতে ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখিন একটা অংশ। মাদকাসক্ত স্বামীদের কারণে নারী ও শিশুদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। ফলে পারিবারিক ভাঙন দেখা দিচ্ছে।
বিশিষ্ট সমাজসেবক ও মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ গাজী নাজিম উদ্দীন বলেন, মাদক প্রাপ্যতা সহজ হওয়ার কারণে কিশোর বয়সেই নেশায় জড়িয়ে পড়ছে অনেকেই। অভিভাবকদের সচেতনতা, সামাজিকভাবে অভিভাবকদের উপর চাপ প্রয়োগ এবং প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া মাদক থেকে তরুণ যুবকদের ফেরানো সম্ভব নয়। দুই যুবকের মৃত্যু ও একাধিক মানুষের অসুস্থতার পর সুশীল সমাজে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও আতঙ্ক। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো শোকে বিহ্বল, আর সাধারণ অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। মৃত্যুর পর আপাতত আ্যালকোহল সেবন কমে এলেও অনেকেই ফিরে যাচ্ছে ইয়াবা বা অন্যান্য মাদকে।
সুশীল সমাজ বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঝে তৎপরতার ঘাটতি রয়েছে, আরও রয়েছে নীরবতা। দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসার অভিযোগ উঠলেও কঠোর পদক্ষেপের উদাহরণ পাওয়া যায়নি। স্থানীয় শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে থুকড়ার আগামী প্রজন্ম অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। থুকড়ার মানুষ এখন একটাই প্রশ্ন তুলছেন, কবে এই মাদকপুরীর অন্ধকার থেকে মুক্তি মিলবে?