আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমে এসেছে। সম্প্রতি এমন তথ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চিঠি দিয়েছেন দেশটির ছয় কংগ্রেসম্যান। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপ নিতেও অনুরোধ জানানো হয়।তবে কংগ্রেসম্যানদের চিঠিতে মিথ্যা এবং বাস্তবতাবিবর্জিত তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে সেকুলার সিটিজেন, বাংলাদেশ।সোমবার (১২ জুন) জাতীয় প্রেস ক্লাবের মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ওই চিঠি প্রত্যাখ্যানের কথা জানান সংগঠনটির বাংলাদেশের আহ্বায়ক ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল।
মিথ্যা চিঠিতে আতঙ্কিত ও হতবাক হওয়ার কথা উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে গত ১৭ মে লেখা এক চিঠিতে দেশটির ছয় কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। এ ঘটনায় বেশ আতঙ্কিত ও হতবাক হয়েছি।’
লিখিত বক্তব্যে তাপস কান্তি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কাছে পাঠানো এক ই-মেইলে সেকুলার সিটিজেনের বাংলাদেশের সদস্যরা দাবি করেছেন, মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের উল্লিখিত চিঠিটি পক্ষপাতদুষ্ট। সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমানোর বিষয়ে ইতিহাস বিকৃত করে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও দাবি করেন, বর্তমান সরকারের সময়ে ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত পরিচয় ভুলে গিয়ে যোগ্যতা ও মেধার সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে সবার সরকারি চাকরি করার অধিকার এবং পেশাগত সুবিধা লাভের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। বিষয়গুলো মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা তাদের বিবেচনায় নেননি। ব্যারিস্টার তাপস কান্তি আরও বলেন, মনে রাখা উচিত, ১৯৭৫ সালের পরে বাংলাদেশের সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হরণ করা হয়েছিল। সংবিধানের সেই অসাম্প্রদায়িক চরিত্র কিছুটা হলেও বর্তমান সরকার ফিরিয়ে এনেছে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। এদিকে কংগ্রেসম্যানদের চিঠিকে একপেশে উল্লেখ করে বিভিন্ন ধর্মের নেতারা বলেন, বিষয়টির মাধ্যমে জামায়াত-বিএনপির সময়কার সংখ্যালঘু নির্যাতন ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সুনন্দ প্রিয় ভিক্ষু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক ড. সুবর্ণ বডুয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. বিমান বডুয়া প্রমুখ।
চিঠিতে যা বলা হয়েছে
কংগ্রেসম্যানদের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে: শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গেছে। পাশাপাশি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষও একইভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও অভিযোগ আনা হয়েছে চিঠিতে। এতে ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্র হরণের অভিযোগ তোলা হয়েছে। যদিও তার কোনো প্রমাণ তুলে ধরা হয়নি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ধ্বংস, ধর্ষণ, বলপ্রয়োগে ধর্মান্তকরণ ও খ্রিস্টানদের ওপর নিপীড়ন বেড়েছে।
এছাড়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা ব্যাপকভাবে ধরপাকড়ের শিকার হচ্ছেন বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, সে জন্য সর্বোচ্চ পরিবেশ তৈরিতে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
কংগ্রেসম্যানদের তথ্য বিভ্রান্তিকর বলছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
এরআগে, জো বাইডেনকে দেয়া ছয় মার্কিন কংগ্রেসম্যানের চিঠিকে বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে অভিযোগটি সত্য নয়, দাবি করেন তিনি। রানা দাশগুপ্ত বলেন, আমরা পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে দেখি, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ববঙ্গে মোট জনসংখ্যার ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু। ১৯৭০ সালের দিকে এসে সেটা নেমে যায় ১৯ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে। অর্থাৎ পাকিস্তানের প্রথম ২৩ বছরে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ হারিয়ে যায়। ‘১৯৭০ সালের সংখ্যালঘুরা একচ্ছত্রভাবে ছয়দফার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার যখন অপারেশন সার্চলাইট শুরু করল, তখন তাদের পাঁচটি নির্দেশনা ছিল। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সংখ্যালঘুদের নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন করা,’ যোগ করেন তিনি। রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের সময় যে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে দাবি করা হয়েছে, তা সঠিক না। গত ৫২ বছর ধরেই সংখ্যালঘুর সংখ্যা কমতে দেখেছি। যদি ছয় কংগ্রেসম্যান জো বাইডেনকে চিঠি দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের সময় অর্ধেক জনসংখ্যা হারিয়ে গেছে বলে দাবি করে, তাহলে তা সত্য না।’
সংখ্যালঘুদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসা নিয়ে বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি পুরোদস্তুর মিথ্যা কথা। বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তায় আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছি।’
সরকারকে চাপে রাখার চেষ্টা
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে কংগ্রেসম্যানদের চিঠিটি সরকারকে চাপে রাখার কৌশল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, চিঠিতে দেয়া তথ্য যেমন সত্য না, তেমনই সেটির ভাষাও কূটনৈতিক শিষ্টাচারসুলভ না। এতে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া হয়েছে ও চিঠির ভাষাও খুবই দুর্বল।
বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে অর্থের বিনিময়ে এ চিঠি দেয়া হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন। তারা বলেন, এমন ঘটনা নতুন না, বরং অনেক আগে থেকেই তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা চালিয়ে আসছে।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, যে ছয় কংগ্রেসম্যান এ চিঠি লিখেছেন, তারা এর আগে কখনও বাংলাদেশ বিষয়ে কথা বলেননি। লবিস্ট নিয়োগ করে তাদেরকে দিয়ে এ চিঠি লেখানো হয়েছে। এমনকি ছয় কংগ্রেসম্যানের মধ্য থেকে মাত্র একজন বব গুড এ চিঠি তার নিজস্ব ওয়েবসাইটে আপ করেছেন। অর্থাৎ চিঠিটিকে তারা নিজেরাও গুরুত্বসহকারে নেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিনিয়র সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খান বলেন, আমরা ধরেই নিতে পারি, এই চিঠি বাংলাদেশের বিরোধী দলের লোকজন কংগ্রেসম্যানদের লবিস্ট ফার্মের মাধ্যমে তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। তাদের বুঝিয়েছে, তাদের দিয়ে চিঠি দিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, আমেরিকা যাতে জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে শান্তিরক্ষী মিশনে না নেয়। এতে বোঝা যায়, মানুষের মধ্যে একটা অস্থিরতা তৈরি করতে, সরকারি দলের ওপর চাপ তৈরি করতে এগুলো করা হচ্ছে।
তার মতে, কিন্তু এই মুহূর্তে এই চিঠি বিপজ্জনক কিছু না। কারণ এটি একটি চিঠি মাত্র। এটার ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে কোনো প্রতিক্রিয়াও দেয়া হয়নি। এটি এখন পর্যন্ত সাধারণ একটি চিঠি।
গবেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করা যায়। যে কোনো দেশ বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান লবিস্ট নিয়োগ করতে পারেন এবং তাদের মাধ্যমে সত্য-অসত্য তথ্য প্রচার করতে পারেন।
তিনি বলেন, কংগ্রেসম্যানরা হলেন মার্কিন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য। সিনেট হচ্ছে উচ্চকক্ষ। তাদেরকে পয়সা দিয়ে যেকোনো কথা বলিয়ে নেয়া যায়। তারা সবসময় যে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলবেন, তা কিন্তু না।
‘সিনেটররা যে বক্তব্য দিয়েছেন এবং তাদের যে ভাষা তাও কূটনৈতিক শিষ্টাচারসুলভ না। চিঠিতে এমন কিছু শব্দ ও বাক্য আছে, যা অন্য দেশের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় না—অনুচিত। কূটনৈতিক ভাষা, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে দরখাস্তের ক্ষেত্রে আমরা যা করি, সেগুলোতেও কিন্তু এটা হয় না,’ যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে কথা বলার অধিকার নেই ও নিপীড়নের অভিযোগ বিষয়ে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘কথা বলার অধিকার নেই বলে যে দাবি তারা করেছে, সেটা কিন্তু সঠিক না। গণতান্ত্রিক অধিকার আছে বলেই..। এই যে তারা বলেছে নিপীড়নের কথা, কয়েকদিন আগেই গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে – এ রকম একটি বিবৃতি দিয়েছিল ৪০ জন মিলে। বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন হিসেবে তা প্রকাশও করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, দেখা গেল যে, ড. ইউনূস নিজে কর ফাঁকি দিয়েছেন, যা তিনি নিজে স্বীকারও করে নিয়েছেন, সেই মামলাকে হয়রানি হিসেবে বলা হয়েছে। একজন বিশিষ্ট পরিচিত ব্যক্তি, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, তিনি কর ফাঁকি দিয়েছেন, যে জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেই মামলাকে আমেরিকার কিছু লোক, যাদের মধ্যে সিনেটর, প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যসহ ৪০ বিশিষ্ট ব্যক্তি সেটাকে ‘হয়রানি’ বলেছেন।
অজয় দাশগুপ্ত বলেন, ‘ধর্মান্ধ, চরমপন্থি, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেয়, তখনই সেটিকে রাজনৈতিক নিপীড়ন বলে উল্লেখ করা হয়। তারা সেটিকে হয়রানি বলছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই বলে দাবি করছেন। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচন যারা বানচাল করতে চেয়েছে, হত্যা, ধর্ষণ তো বটেই; আগুন জ্বালানো, পেট্রোল বোমা, ২০১৫ সালে তারা একটানা তিন মাস হরতাল-অবরোধ করেছে, সেইসব সহিংস কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাঁড়িয়েছে, পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটাকেও তারা কিন্তু রাজনৈতিক নিপীড়ন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।’
‘প্রকৃত সঠিক কোনো ঘটনা ঘটলে, রাষ্ট্র যদি কোনো অন্যায় করে, মানুষের অধিকার হরণ করে, সেটা নিয়ে তারা কথা বলতে পারেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, এই ছয় কংগ্রেসম্যান যেসব কথা বলেছেন, তার অধিকাংশই মনগড়া অথবা অপরের শিখিয়ে দেয়া বুলি। লবিস্ট ফার্মের হয়ে কাজ করার মতো করে তারা কথা বলেছেন,’ যোগ করেন অজয় দাশগুপ্ত।