বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৫৬ অপরাহ্ন
নোটিশ
যে সব জেলা, উপজেলায় প্রতিনিধি নেই সেখানে প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। বায়োডাটা সহ নিউজ পাঠান। Email: newssonarbangla@gmail.com

উপকূলের লোনা জলে হার না-মানা নারী: বাঘবিধবা থেকে স্বাবলম্বী রোল মডেল

এস,এম এ রউফ,কয়রা,খুলনা প্রতিনিধি
Update : বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫, ৬:১১ অপরাহ্ন

​এস এম এ রউফ, কয়রা (খুলনা) প্রতিনিধি: ​আজ ১৫ অক্টোবর, আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। যখন বিশ্বজুড়ে গ্রামীণ নারীর অবদানকে সম্মান জানানো হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের নারীরা লড়ছেন এক কঠিন বাস্তুসংস্থানের বিরুদ্ধে। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার এই অঞ্চলের নারীরা একদিকে যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারাচ্ছেন ঘরবাড়ি, তেমনি অন্যদিকে লোনা জলের অভিশাপ তাঁদের স্বাস্থ্য ও নিরাপদ মাতৃত্বকে ঠেলে দিচ্ছে চরম ঝুঁকিতে। গবেষণায় দেখা যায়, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় (১৯৮০ সালের তুলনায় প্রায় তিনগুণ) ৩% বেশি নারী ইউটিআই (ইউরেনারী ট্রাক ইনফেকশন)ও গাইনোকলজিক্যাল সমস্যায় ভুগছেন।
​তবে এই প্রতিকূলতার মধ্যেও কেউ কেউ হার মানেন না। আজ তেমনই এক সংগ্রামী নারী, খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের বাঘবিধবা হালিমা খাতুনের ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য গল্প।


​জীবনের কঠিনতম সংগ্রাম:
মাত্র ১২ বছর ৩ মাস বয়সে বিয়ে, আর তার ৭ মাসের মাথায় সুন্দরবনের বনজীবী স্বামী আলমগীর বাঘের আক্রমণে নিহত। ৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হালিমা তখন নিজেই যেন এক শিশু। স্বামীর মৃত্যু, অনাগত সন্তানের ভার এবং শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় না-পাওয়া—অবর্ণনীয় এক কষ্টের পাহাড় চাপা পড়েছিল তাঁর ওপর। জীবন ও জীবিকার তাগিদে খুলনা শহরে গিয়েও মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে গ্রামে ফিরতে বাধ্য হন।
​উপজেলা সদরে একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া করে হালিমা অন্যের বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে মেয়েকে বড় করার স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু নিয়তির খেলা এখানেই শেষ নয়। কিছুদিনের মধ্যেই হার্টের সমস্যা ধরা পড়লে তিনি ভারী কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মাথার ওপর যেন পুরো আকাশ ভেঙে পড়ে। স্বাবলম্বী হতে ছোটখাটো উদ্যোগ বা ব্যবসার জন্য ঋণ বা সহযোগিতার আশায় ছুটতে শুরু করেন। কিন্তু এই পথচলা ছিল অন্ধকারময়, কারণ কোনো প্রতিষ্ঠানই এই সুবিধাবঞ্চিত হালিমার পাশে দাঁড়ায়নি।
​আইসিডি’র হাত ধরে ভাগ্যের চাকা ঘোরা:
ঠিক এই চরম হতাশার মুহূর্তে হালিমার পাশে দাঁড়ায় উপকূলের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন’ (আইসিডি)। এই সহযোগিতা তাঁর জীবনে নিয়ে আসে নতুন ভোর। সামাজিক অবহেলা ও বঞ্চনাকে পায়ে মাড়িয়ে হালিমা ফিরে পেয়েছেন সামাজিক মর্যাদা। আজ তিনি আর ঝিয়ের কাজ করেন না। কয়রা বাজারে তাঁর ছোট চায়ের দোকান এখন আয়ের উৎস।
​বাঘবিধবা হালিমা খাতুন বলেন, “এখন প্রতিদিন চায়ের দোকান থেকে ভালো আয় হচ্ছে। ঠিকমতো দু’মুঠো ডাল-ভাত খেতে পারি এবং সঞ্চয়ও করছি। এলাকার মানুষ এখন আমাকে সম্মান করে। আমার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প যখন মানুষের মুখে শুনি, খুব ভালো লাগে। হার্টের সমস্যার পর যখন ঝিয়ের কাজ হারালাম, তখন চরম দুশ্চিন্তা আর হতাশার মাঝে আইসিডি আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।”
​গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন ও ভবিষ্যতের ভাবনা:
হালিমা খাতুন এখন উপকূলের অসংখ্য নারীর জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম, একটি ‘রোল মডেল’। একসময় যাঁরা তাঁকে ঝিয়ের কাজের বিনিময়ে পচাবাসী খাবার দিতেন, আজ তাঁরাই তাঁর চায়ের দোকানের নিয়মিত ক্রেতা।
​তবে হালিমার মতো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবল স্পৃহা থাকা সত্ত্বেও উপকূলের অসংখ্য নারী আজ অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবসে তাই কেবল নারীদের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা নয়, বরং তাঁদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। উপকূলীয় নারী স্বাস্থ্যের সুরক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। হালিমার মতো নারীদের খুঁজে বের করে পাশে দাঁড়াতে পারলে গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন এবং তাঁদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Theme Created By Uttoron Host