স্মৃতির পাতায় হঠাৎ ভেসে এলো ১৯৭১ এর আবাইপুর যুদ্ধের সেই মর্মান্তিক ঘটনা। আমাদের বাহিনিতে ছিলেন শৈলকুপা থানার হড়রা গ্রামের ইসমাইল হোসেন। আমাদের ক্যাম্প ছিল বাগুটিয়া এবং নজরুলের ক্যাম্প ছিল কামান্না। ঐ দিন ছিল ১৩ই অক্টোবর ইসমাইলের বিয়ে। যেহেতু ইসমাইল কামান্না ক্যাম্পে নজরুলএর অধীন ছিল সে হিসাবে নজরুল নিজে উপস্থিত থেকেই ইসমাইলকে পার্শ্ববর্তী গ্রামে বিয়ে দেয়। ঐ রাতে ইসমাইল এর বাসর হওয়ার কথা। হঠাৎ সংবাদ এলো রাতে পাকসেনারা শৈলকুপার আবাইপুর অভিমুখে রওয়ানা দেবে। গোপনসুত্রে সংবাদ পেয়ে আমরাও প্রস্তুতি নিলাম পাকসেনাদের প্রতিহত করার। কামান্নায় অবস্থিত নজরুলের বাহিনিকে আবাইপুর ওয়াপদা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা বাগুটিয়া অবস্থান নিলাম। শৈলকুপা হয়ে আর্মি এলে বাগুটিয়ায় বাধা দেওয়া হবে এবং আবাইপুর থেকে নজরুলের বাহিনি আমাদের সাথে যোগ দেবে। মাগুরা হয়ে আক্রমন হলে শ্রীকোল বাজারে অবস্থানরত আকবর বাহিনির সাথে যোগ দেবে। যথারীতি নজরুল তার বাহিনি নিয়ে কামান্না অভিমুখে রওয়ানা দিল। যাওয়ার সময় নজরুল ইসমাইল এর শ্বশুর বাড়ী যেয়ে ইসমাইল কে বলল তোমার আজ বাসর তুমি থাক কিন্তু ইসমাইল নাছোড় সে নজরুলের সাথে যাবেই। কারন সবাই নজরুল কে খুব ভালবাসতো। ইসমাইলের নববধু কোনরকমে ইসমাইলকে বাসর ফেলে যেতে দেবেনা। নজরুলও ইসমাইলকে তার শ্বশুরবাড়ীতে বাসর কাটাতে খুব চাপ দিল। কিন্ত ইসমাইল নাছোড়। অবশেষে ইসমাইল বাসর ছেড়ে যুদ্ধে চলে গেল। নববধুকে বলে গেল কাল ফিরে এসে বাসর হবে। ঐ রাতেই পাকসেনাদের আক্রমনে নজরুল, ইসমাইল সহ মোট ১৭ জন স্পটে আবাইপুর ওয়াপদাক্যাম্পে শহীদ হয়। এদিকে সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল শত শত মানুষ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে ছুটে এলো। চারদিকে শোকের ছায়া নেমে এলো। সবচেয়ে হৃদয় বিদারক যে ঘটনাটি ঘটেছিল, তার বর্ণনা শুনুন- এলাকাবাসীর পাশাপাশি ইসমাইলের নববধু আলেয়া যে বাসরের অপেক্ষায় ছিল। সেই আলেয়াও এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ দেখতে এবং তার স্বামীকে ফিরিয়ে নিতে। তখনও আলেয়ার হাতের মেহেদির গন্ধ বেরুচ্ছে, পরনে কনের পোশাক। ১৭ টি লাশ পাশাপাশি সাজানো। গণকবর ও খোড়া হয়ে গেছে। এক এক করে লাশগুলো কবরে নামানো হচ্ছে। যখন ইসমাইলের লাশ কবরে নামাবে অমনি নববধু আলেয়া ইসমাইলের লাশ যাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছা গেল। সে যেন পাথর মুর্তির মতো বলতে চাইল ‘আমার স্বামীকে আমি কবরে নিতে দেবোনা। আমার বাসরের কি হবে’???
সেই মুহুর্তে সবাই নির্বাক। ইতোমধ্যে মুর্ছা যাওয়া আলেয়াকে তার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন ঘাড়ে করে তাদের বাড়ীর দিকে নিয়ে গেল। জানিনা সেই আলেয়া আজ কোথায় আছে, কেমন আছে! বেঁচে আছে কিনা!”