রয়েল আহমেদ,শৈলকুপা(ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি:ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বড়ুরিয়া গ্রাম, মধ্য পাড়ায় প্রবেশ করতেই দেখা মেলে নদী পাড়ে বসে ষাটোর্ধ বয়সের কয়েকজন মানুষ। তাদের সকলের চোখে চিন্তার ভাজ। কখন যেন সর্বনাশী গড়াই কেড়ে নেয় শেষ সম্বল ভিটেবাড়ি। এই মানুষগুলো এরই মধ্যে হারিয়েছে ফসলী জমি। এখন অন্যের জমিতে কাজ করে চলে সংসার।
এদের মধ্যেই একজন জাহাঙ্গীর মন্ডল। তিনি বলেন, আমার ১০ বিঘা ফসলী জমি নদী গর্ভে চলে গেছে। ভাঙনের যে অবস্থা তাতে মনে হয় ভিটেবাড়িও এবছর ঠেকাতে পারবো না।
সরেজমিনে গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, এই মানুষগুলোর মত ভাঙন আতঙ্ক গ্রামে বসবাসকারী সকল মানুষের মধ্যে। চলতি বছরের জুন মাসের শুরুর দিকে ভাঙন শুরু হলেও পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে এখন তীব্র আকার ধারন করেছে। পাট, কলা ক্ষেত , হলুদের জমি সহ ভাঙতে শুরু করেছে ফসলী জমি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফেলা জিও ব্যাগও স্রোতের তীব্রতায় তেমন কাজে আসছে না। অনেক ঘরবাড়িও তীব্র ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে। গ্রামটিতে এক সময় ছিল অসংখ্য মানুষের বসবাস, গড়াই নদীর ভাঙ্গনে এখন পাল্টেছে সেই চিত্র। অনেকেই হারিয়েছেন সহায় সম্বল, হয়েছেন নি:স্ব, ছেড়েছেন গ্রাম। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যে, উপজেলায় গড়াই নদীর বহমান অংশ ২০ কিলোমিটার। যার মধ্যে বড়ুরিয়া গ্রামে ১.৫০, কৃষ্ণনগরে ১ কিলোমিটার, গোসাইডাঙ্গা ৫০০ মিটার, মাদলা এলাকায় ১.৫০, মাঝদিয়াতে ১ কিলোমিটার এবং লাঙ্গলবাধ এলাকায় ৫০০ মিটার সহ মোট ৬ কিলোমিটার ভাঙ্গনপ্রবন। তবে বেশী ভাঙ্গন তীব্রতা বড়ুরিয়া গ্রামের দেড় কিলোমিটার অংশে। কোথাও বেশী, কোথাও কম, সেই হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ৫ মিটার অর্থাৎ ১৫ ফিট নদী গর্ভে বিলিন হচ্ছে। তবে স্থানীয়রা বলছে আরো বেশী পরিমান জমি ভেঙে যাচ্ছে। ১৯৬২ সালের পর থেকে ভাঙন থাকলেও গেল ২০ বছরে তীব্রতা বেড়েছে কয়েকগুন। সিএস রেকর্ড অনুযায়ী, ১৪ শ’ ৫৭ বিঘা ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং ১৪৩ বিঘা সরকারী খাস জমি বড়ুরিয়া মৌজায়। এখন তা দাড়িয়েছে গড়ে ২ শ’ ৫০ বিঘায়। গ্রামটিতে বসতিও ছিল আনুমানিক ৭শ’ পরিবারের কিন্তু অনেকেই অন্যত্র বসতি স্থাপন করেছেন। এখন প্রায় ২শ’ পরিবারের বসতি রয়েছে দাবি স্থানীয়দের। নদীর ওপারে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা। এপারের জমি ভেঙে ওপাশে জেগে ওঠা চরের জমিতে কুষ্টিয়ার মানুষ যেতে দেয় না, অভিযোগ স্থানীয়দের। আবার চর উদ্ধারেও কেউ ব্যবস্থা নেয় না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ২০১৯ ও ২০২১ সালে ডিপিপি প্রকল্প, পরিকল্পনা কমিশনে দাখিল করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। চলতি বছরে গড়াইয়ের ভাঙন রোধে অস্থায়ী ভিত্তিতে সমীক্ষা কাজের আওতায় ১৭৫ কেজি ওজনের বালি ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ১ জুন থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২৬ সালের জুন মাসে। ১৩ কোটি টাকা’র এই প্রকল্পিটি বাস্তবায়িত হবে ৪ টি ধাপে।
বড়ুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা সুন্দরী খাতুন বলেন, আমাদের প্রায় ৩০ বিঘা জমি ছিল, এখন তা ১০ বিঘায় দাড়িয়েছে।
গ্রামের বাসিন্দা মনি মোল্লা বলেন, গ্রামের প্রায় ১৪ শ’ বিঘা জমি চলে গেছে কুষ্টিয়া সাইডে।
বড়ুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা বাবুল মোল্লা বলেন, এপাশ থেকে ভেঙে নদীর ওপারে চর জেগে উঠেছে। সেখানে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার মানুষ জবরদখল করে খাচ্ছে। সেখানে খোকসার মানুষ আমাদের যেতে দেয়না আবার প্রশাসনের কেউ উদ্দোগ নেয়না এই জমি উদ্ধারে। ক্রমেই আমরা নিঃশ্ব হচ্ছি সম্বল হারিয়ে। গ্রামের মানুষের কষ্টের কথা ভেবে সরকার যেন ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেয় এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার দাস বলেন, বর্তমানে বর্ষার শুরুতে ভাঙ্গন রোধে অস্থায়ী সমীক্ষা কাজ চলমান আছে। আগামী বছরের জুন মাস পর্যন্ত কয়েকটি ধাপে কাজটি চলবে। এরপর স্থায়ী কাজ করা হবে বরাদ্দের ভিত্তিতে। নদীর এই অংশটুকু অবতল হওয়াতে পানির চাপ বৃদ্ধিতে পলি সরে ভাঙ্গন দেখা দেয়। তবে জমি উদ্ধারের বিষয়টি জেলা প্রশাসনের বলেও জানান তিনি। শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্নিগ্ধা দাস জানান, নদীর সীমানা নির্ধারনে জেলা প্রশাসক বরাবর পত্র পাঠানো হয়েছে।
ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল বলেন, আমাদের অংশ ভেঙে গিয়ে নদীর ওপারে কুষ্টিয়া সাইডে জেগে ওঠা চরের জমি উদ্ধার ও সেখানে যেন শৈলকুপার মানুষ চাষাবাদ করেেত পারে তা নিয়ে এরই মধ্যে উদ্দোগ গ্রহন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও অন্যান্য দপ্তরের সম্মিলিত বৈঠকের পর জরিপ করে সীমানা নির্ধারনের জন্য সরকারের জরিপ অধিদপ্তরে পত্র পাঠিয়েছি। আশা করি সরকার দ্রুতই বিধিসম্মত ভাবে উদ্দোগ নেবেন আর তখন নদী পাড়ের সমস্যা থাকবে না।